জীবন রাঙাতে রঙিন মাছ চাষ

শিহাব উদ্দিনের মাছের খামার। ছবি: প্রথম আলো
শিহাব উদ্দিনের মাছের খামার। ছবি: প্রথম আলো

পানিতে ভাসছে, ডুব দিচ্ছে নানা রঙের মাছ। লাল, নীল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ রঙের মাছের ছড়াছড়ি। গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্ভ, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কই, মলি, গাপটি, অ্যাঞ্জেল প্রভৃতি বর্ণিল মাছ দেখলে চোখ জুড়ায়, মন ভরে যায়। বাসাবাড়ির অ্যাকুরিয়ামে শোভা পেয়ে থাকে এই মাছ।

এসব মাছের চাষ করেছেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের তরুণ উদ্যোক্তা শিহাব উদ্দিন। রঙিন মাছের চাষ তাঁর জীবনকে রাঙিয়ে দেবে বলে আশাবাদী শিহাব। এই মাছের চাষের মাধ্যমে তিনি নিজের পাশাপাশি ভাইবোনেরপড়ালেখার খরচ জোগাচ্ছেন। ফলে দরিদ্র বাবাকে আর কষ্ট করে সন্তানদের পড়ার খরচ জোগাড় করতে হচ্ছে না।

শিহাবের বাড়ি কালীগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি ইউনিয়নের হাসানহাটি গ্রামে। তিনি যশোর এম এম কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বোন ফারজানা ইয়াসমিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আর ছোট ভাই ফরহাদ উদ্দিন নবম শ্রেণির ছাত্র।

শিহাব জানান, ২০১৮ সালের শুরুতে বাড়ির আঙিনায় একটি পরিত্যক্ত জমিতে ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোলেন অরনামেন্টাল ফিশ ফার্ম। পোনা কেনা, খাবার দেওয়াসহ নানা কাজে তাঁর খরচ হয়েছিল ৩৪ হাজার টাকা। বছর ঘুরতেই মাছ বিক্রি করেছেন প্রায় এক লাখ টাকার। এ বছর মা মাছ ছেড়েছেন পুকুরে। বাচ্চা তৈরি করবেন। ব্যবসা আরেকটু সম্প্রসারিত করবেন। তিনি জানান, অ্যাকুরিয়ামের দোকানে রঙিন মাছ দেখে ভালো লাগে তাঁর। কৌতূহলী হয়ে মাছের দাম জানতে চান। জানতে পারেন মাছগুলো বেশ দামি। দোকানি জানান, রঙিন মাছগুলো বিদেশ থেকে আনা হয়। বর্তমানে দেশেও এই মাছের চাষ হচ্ছে। সেখান থেকেই রঙিন মাছ চাষের পরিকল্পনা মাথায় আসে।

বছরের শুরুতে গর্ত খুঁড়ে পলিথিন বিছিয়ে একটি চৌবাচ্চা তৈরি করে অল্প কয়েকটি রঙিন মাছ ছাড়েন শিহাব। দুই মাসের মধ্যে মাছগুলো বেশ বড় হয়ে যায়। রঙিন মাছগুলো বড় হওয়ার পর তাঁর উৎসাহ বেড়ে যায়। তখন আরও মা মাছ সংগ্রহ করেন সাতক্ষীরার কলারোয়া থেকে। বিভিন্ন প্রজাতির ১৬০টি মাছ নিয়ে আসেন। এই মাছ বড় করতে তাঁকে আরও পাঁচটি চৌবাচ্চা তৈরি করতে হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ছয়টি চৌবাচ্চায় রেণু ছাড়া হয়। অধিকাংশ চৌবাচ্চা ১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫ ফুট প্রস্থের। এরপর মাছগুলো বড় হতে থাকে। একপর্যায়ে ডিম দেয়। ডিম থেকে রেণু–পোনা উৎপাদিত হয়, যা বাজারে বিক্রি করেন। যাঁরা অ্যাকুরিয়াম ব্যবসা করেন, তাঁরা এখন তাঁর থেকে এই মাছ কেনেন।

শিহাব বলেন, চলতিমাসের শুরুতেতিনি ছয়টি চৌবাচ্চার পাশাপাশি আরও একটি পুকুরে এই মাছের চাষ করছেন। যেখানে তিনি দেড় হাজার মা মাছ আর দেড় শ পুরুষ মাছ ছেড়েছেন। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে এগুলো বড় হবে। তখন চৌবাচ্চায় দিয়ে ডিম ফোটাবেন। তারপর রেণু বিক্রি করবেন। আশা করছেন, এবার কয়েক লাখ টাকার রঙিন মাছ বিক্রি করতে পারবেন।

বর্তমানে খামারে গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্ভ, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কই, মলি, গাপটি, প্লাটিসহ ১৬ প্রজাতির মা মাছ রয়েছে। একটি মাছ বছরে প্রায় ৩ হাজার রেণু–পোনা দেবে। ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি বড় হলে এই মাছ বিক্রি করা যাবে। শিহাব বলেন, ‘শুরুতে এলাকার মানুষ এই চাষ দেখে হাসাহাসি করতেন। সবাই মনে করতেন এটা আমার খেয়ালিপনা। কিন্তু হাল ছাড়িনি। এখন এলাকার মানুষ ছাড়াও মৎস্য কর্মকর্তারা তাঁর এই মাছ দেখতে আসছেন। অনেকে খামার দেখতে এসে মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।’

ঝিনাইদহ থেকে বদলি হয়ে যাওয়া মেহেরপুর সদরের জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (সদর) রবিউল ইসলাম এই উদ্যোগকে ভালো উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, এর চাষপ্রণালি অন্য মাছের মতো। শুধু আলাদা কিছু খাবার দিতে হয়। তবে রবিউল ইসলাম এ মাছের বাজার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, অনেকে এই মাছ চাষের উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ কম। কারণ, ঘরের শোভা বাড়ানো ছাড়া এসব মাছের তেমন কোনো উপযোগিতা নেই। ফলে বাজারও খুব বেশি বড় নয়।

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শিহাবকে এই মাছ চাষে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন। সরকারিভাবে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয় বলে জানান শিহাব উদ্দিন। সব ঠিকঠাক থাকলে এই খামারই জীবনকে বদলে দেবে এমনটি আশা তাঁর।

কালীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাইদুর রহমান শিহাবের রঙিন মাছের চাষ দেখেছেন। ব্যতিক্রমী উদ্যোগ তাঁর ভালো লেগেছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলের আবহাওয়ায় এই মাছ চাষ সম্ভব। শিহাবকে পরামর্শ, ঋণসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।’