মেয়র পদে লড়াইয়ে তাঁরাও

মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, আনিসুর রহমান, আবদুস সামাদ, শাহীন খান, আকতারুজ্জামান, বাহারানে সুলতান
মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, আনিসুর রহমান, আবদুস সামাদ, শাহীন খান, আকতারুজ্জামান, বাহারানে সুলতান

সিটি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে তাঁদের ভূমিকা মোটেও কম নয়। লোকে চিনুক আর না চিনুক সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁরা ঠিকই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে কর্মী–সমর্থকদের বিশাল বহর না থাকলেও পথে–দোকানে, বাসা–বাড়িতে গিয়ে ভোট চাচ্ছেন, নানা প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। লোকজনও কৌতূহল নিয়ে তাঁদের কথা শুনছেন। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে এমন মেয়র পদপ্রার্থীর সংখ্যা ছয়জন।

মেয়র পদে প্রার্থী হলেও নির্বাচনে ‘পাস’ করবেন না জেনে এখন পর্যন্ত প্রচারেই নামেননি এক প্রার্থী। শহরের পরিবেশ নষ্ট হবে ভেবে পোস্টার লাগাননি আরেক প্রার্থী। ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী বেড়ে যাওয়ায় ভোট কমে যাওয়ার শঙ্কায় আছেন আরেকজন।

দুই সিটিতে মেয়র পদে লড়ছেন মোট ১৩ প্রার্থী। ঢাকা দক্ষিণে (ডিএসসিসি) ৭ জন আর উত্তরে (ডিএনসিসি) ৬ জন। তবে আলোচনা বেশি বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার মেয়র প্রার্থীকে ঘিরেই। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দুই মেয়র প্রার্থী কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে দিনরাত গণসংযোগ করছেন। সিপিবি শুধু ডিএনসিসি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে। তাদের প্রার্থী আহাম্মদ সাজেদুল হক প্রতিদিন জনসংযোগ করছেন। বাকি ছয় মেয়র প্রার্থীকে নিয়ে আলোচনা নেই বললেই চলে। এই মেয়র প্রার্থীদের নির্বাচনী পোস্টারও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এসব প্রার্থীর দাবি, বড় দুই দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের অসংখ্য পোস্টারের ভিড়ে তাঁদের অল্পসংখ্যক পোস্টার চোখে পড়ে না।

কম আলোচিত এই মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে পাঁচজন ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। তখন তাঁরা জামানত হারিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন বাংলাদেশ কংগ্রেসের আকতারুজ্জামান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির বাহারানে সুলতান, জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আবদুর রহমান ও শেখ ফজলে বারী মাসউদ।

অন্যদিকে ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের মেয়র উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে জামানত হারানো দুই প্রার্থী এবারও প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা হলেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের শাহীন খান ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আনিসুর রহমান দেওয়ান।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০ অনুযায়ী, মেয়র নির্বাচনের ক্ষেত্রে ২০ লাখের বেশি ভোটারসংবলিত নির্বাচনী এলাকার জন্য জামানত ১ লাখ টাকা। মোট প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, তাহলে তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও কম আলোচিত প্রার্থী জয়ের চেয়ে সম্মানজনক ভোট পাওয়ার আশা করছেন। তাঁরা বলছেন, জয়-পরাজয়ের চেয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা জরুরি।

আবদুস সামাদ।
আবদুস সামাদ।


সামর্থ্য অনুযায়ী প্রচার সামাদের
দক্ষিণ সিটিতে গণফ্রন্টের মেয়র প্রার্থী আবদুস সামাদ। উচ্চমাধ্যমিক পাস সামাদ পেশায় রাজনীতিবিদ ও দৈনিক শিরোমনি পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। এবারই প্রথম ডিএসসিসির মেয়র নির্বাচনে তিনি অংশ নিচ্ছেন। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ঢাকা-৮ আসনে প্রার্থী ছিলেন তিনি।

বড় দলের তুলনায় নিজের পোস্টার কম বলে জানান আবদুস সামাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রচারের জন্য মাইক লাগিয়ে তিনটি রিকশা মাঠে নামানো হয়েছে। ১৫-২০ জনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ চালাচ্ছেন।

সামাদ বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের দুর্নীতি, মশার অত্যাচারের প্রতিবাদস্বরূপ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। নির্বাচিত হব কি হব না, সেটি পরের ব্যাপার।’

আকতারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ।
আকতারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ।


এবার ভোট বেশি পাওয়ার আশা
২০১৫ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লাউ প্রতীক নিয়ে লড়েছিলেন আকতারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ। ওই নির্বাচনে তিনি পান ৩৬২ ভোট। এবার বাংলাদেশ কংগ্রেস থেকে ডাব প্রতীক নিয়ে লড়ছেন তিনি।

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, আকতারুজ্জামান বিএ পাস। তিনি দৈনিক আজকের দর্শন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০ তারিখে প্রতীক বরাদ্দের পর পোস্টার, ব্যানার লাগিয়েছিলাম। এর মধ্যে বেশ কিছু পোস্টার, ব্যানার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আচরণবিধি মেনে প্রচার চালাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি।

শাহীন খান
শাহীন খান


পরিবেশ নষ্ট করতে চাননি শাহীন খান
ঢাকা উত্তরে বাঘ প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে লড়ছেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির নেতা শাহীন খান। ২০১৯ সালে উত্তর সিটির উপনির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করে তিনি পেয়েছিলেন ৮ হাজার ৫৬০ ভোট। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, শাহীন খান স্বশিক্ষিত, পেশায় ব্যবসায়ী।

শাহীন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়র প্রার্থী হয়ে শহরের পরিবেশ নষ্ট করতে পারি না। তাই পোস্টার কম লাগানো হয়েছে, তবে নিয়মিত গণসংযোগ করা হচ্ছে।’

বাহারানে সুলতান।
বাহারানে সুলতান।


সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে নির্বাচন
দক্ষিণ সিটির নির্বাচনে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মেয়র প্রার্থী বাহারানে সুলতান ২০১৫ সালের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে শার্ট প্রতীক নিয়ে লড়ে তিনি পান ৩১৩ ভোট। তবে এবার কোনো পোস্টার লাগাননি, লিফলেটও বিতরণ করেননি। পেশায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যবসায়ী বাহারানে সুলতান ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি।

বাহারানে সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পাস করব না (নির্বাচনে জয়লাভ) এটি নিশ্চিত। রাজধানীর বাড়িভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে আন্দোলন করছি। এই আন্দোলনকে পোক্ত করাই প্রার্থিতার উদ্দেশ্য। প্রার্থিতা দিয়েছি সচেতনতা তৈরির জন্য, পাস করার জন্য না।’

আনিসুর রহমান দেওয়ান।
আনিসুর রহমান দেওয়ান।


ভোট কমে যাওয়ার শঙ্কায় আনিসুর
২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) মেয়র পদে উপনির্বাচন হয়। ওই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। মেয়র পদে লড়েন পাঁচজন। তাতে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আনিসুর রহমান দেওয়ান পান ৮ হাজার ৬৯৫ ভোট। এবারও ডিএনসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন তিনি।

বিএসসি পাস আনিসুর রহমান দেওয়ানের পেশা রাজনীতি ও সমাজসেবা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বড় দলের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা অনেক পোস্টার লাগিয়েছেন। তাঁদের পোস্টারের ভিড়ে আম প্রতীকের অল্প কিছু পোস্টার চোখে পড়ে না।

গত উপনির্বাচনে সাড়ে ৮ হাজারের ওপরে ভোট পেলেও এবার ভোট কত পাবেন তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন আনিসুর। এই মেয়র প্রার্থী বলেন, ‘উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম ছাড়া তেমন বড় কোনো প্রার্থীও ছিল না। এবার অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী। ফলে ভোট কেমন পাব তা বুঝতে পারছি না।’

সাইফুদ্দিন আহমেদ ওরফে মিলন।
সাইফুদ্দিন আহমেদ ওরফে মিলন।


শুরুতে নীরব
দক্ষিণ সিটিতে জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ ওরফে মিলন। ২০১৫ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি ৪ হাজার ৫১৯ ভোট পান। সাইফুদ্দিন আহমেদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন বলে গুঞ্জন ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে তিনি নির্বাচনী মাঠে থেকে যান। প্রতীক বরাদ্দের পর প্রথমে কয়েক দিন নীরব থাকলেও এখন নেতা-কর্মীদের নিয়ে নিয়মিতই প্রচার চালাচ্ছেন তিনি। এই মেয়র প্রার্থীর দাবি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতোই তাঁর নির্বাচনী প্রচার চলছে।

মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, নিজের পরিচয় জানান দেওয়ার জন্য অনেকে মেয়র প্রার্থী হন বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জেতার সম্ভাবনা নেই জেনে এসব প্রার্থী অনেক সময় নির্বাচনের প্রচারে টাকাপয়সাও খরচ করেন না। আর ভুঁইফোঁড় প্রার্থীরা কিছু সুযোগ-সুবিধা নিতে চান।