ঢাকার নির্বাচনে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ, ইসির শুধুই আশ্বাস

ভোটের মাঠে ‘রেফারি’ ধরা হয় নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ভোটের আর মাত্র চার দিন বাকি। কিন্তু নির্বাচনের মাঠ ও রেফারির ভূমিকা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছে না বিরোধী দল বিএনপি। সরকারি দল আওয়ামী লীগে নির্বাচনের পরিবেশ ও ইসির ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে বিএনপির অভিযোগের মুখে ইসি যেন প্রভাবিত না হয়, সে জন্য উল্টো চাপে রেখেছে সরকারি দল।

গতকাল সোমবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য কমিশনারদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উচ্চপর্যায়ের দুটি প্রতিনিধিদল। আলোচ্য বিষয় ছিল রোববার গোপীবাগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। ইসির কাছে দুই দলই এ সংঘর্ষের ঘটনায় একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছে। তবে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে ইসির খুব একটা ভূমিকা নেই, এমনটি বলার চেষ্টা করেছেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা। বরং ভোটের আগে এমন পরিস্থিতি এড়াতে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এর বাইরে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান।

সিটি নির্বাচন উপলক্ষে দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ দিয়েছে ইসি। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘন ঠেকাতে তাঁদের তৎপরতা চোখে পড়ে না। প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, প্রচারের সময় যান চলাচলে বাধা, লাগাতার উচ্চ আওয়াজের শব্দযন্ত্রের ব্যবহার, প্রতিপক্ষের প্রার্থীর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, রাস্তা দখল করে নির্বাচনী কার্যালয় স্থাপন, পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার টাঙানোসহ নানা অভিযোগ জমা হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে। এগুলো নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা বা ইসির তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। এরই মধ্যে রোববার খোদ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ও সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করার বিষয়ে ইসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর আগেও তিনি কমিশনের ভূমিকা নিয়ে নানা সমালোচনা করে সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের চিঠি দিয়েছেন।

এ পরিস্থিতিতে গতকাল প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ইসিতে গিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করায় ভোটের মাঠে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল বিকেলে ইসির সঙ্গে প্রথম বৈঠক হয় বিএনপির। পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। দুটি বৈঠক শেষে ব্রিফ করেন সিইসি নূরুল হুদা। ভোটে শঙ্কার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, এত বড় শহরে ৫৪ লাখ ভোটারের মধ্যে মাত্র দুটো ঘটনা ঘটেছে। এটা নিয়ে নির্বাচন বানচাল, ব্যাহত করা বা বিনষ্ট করার কোনো কারণ ঘটেনি। এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘আমার আশঙ্কা নাই।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। ফাইল ছবি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। ফাইল ছবি

গোপীবাগের ঘটনার বিষয়ে সিইসি বলেন, ফৌজদারি অপরাধের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। রিটার্নিং কর্মকর্তা, ওসি, ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আসেনি। কোনো প্রার্থী দায়ী থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে নোটিশ দেওয়া হবে। আর ফৌজদারি অপরাধের বিচার করবেন আদালত।

নূরুল হুদা বলেন, গোপীবাগে হামলার ঘটনার মামলা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। তিনি ওসির সঙ্গে কথা বলেছেন। ওসি জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে কেউ আসেনি। এদিকে আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা মামলা করেছে। ফৌজদারি অপরাধ হলে যেকোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা করতেই পারে।

সিইসি বলেন, আওয়ামী লীগ গোপীবাগের ঘটনায় বিএনপিকে দায়ী করেছে। তাদের বক্তব্য, এই সুযোগে বিভিন্ন জায়গা থেকে সন্ত্রাসীরা ঢাকায় ঢুকবে, তারা নির্বাচনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ইসি বলেছে, অভিযোগ পেলে ফৌজদারি অপরাধ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ধরনের ঘটনা সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তরায় কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘অবশ্যই এ ধরনের ঘটনা নির্বাচনের প্রতি একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ধরনের ঘটনা হঠাৎ করে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু হয়। আমরা আগে থেকে বললেই থেমে যাবে, তা তো না।’

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ফুটপাতে ১০০ টির বেশি নির্বাচনী কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে সিইসি বলেন, ‘ওটা আমরা উঠিয়ে দেব। ১০০টা যে আছে, এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। কোথাও কোথাও থাকতে পারে। আমি তা জানি না। সেটার জন্য আমরা তাৎক্ষণিকভাবেই রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জানিয়েছি, ফুটপাতের ওপর যদি নির্বাচনী ক্যাম্প থাকে, সেটা তুলে দেবে।’

দুই দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে সিইসি ছাড়াও কমিশনার মাহবুব তালুকদার, কবিতা খানম ও রফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

আচরণবিধি লঙ্ঘন ও সহিংসতার বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গাবতলী ও গোপীবাগে যে সংঘর্ষ হয়েছে, সেটা নির্বাচনী সহিংসতা। এগুলো রোধ করা ইসির দায়িত্ব। গাবতলীর ঘটনার পর ওই ওয়ার্ডে ভোট স্থগিত করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে গোপীবাগের ঘটনা হয়তো ঘটত না। ইসি তার ক্ষমতার মধ্যে থাকা আইনসিদ্ধ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এখন ভোটের দিন কী হয়, সেটাই দেখার বিষয়।

বিএনপিকেই দোষ দিল আওয়ামী লীগ
ইসির সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, গোপীবাগের সংঘর্ষের হোতা বিএনপি। তাঁদের কাছে এ-সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ আছে। সেটা ইসিকে লিখিতভাবে দেওয়া হয়েছে।

এইচ টি ইমাম দাবি করেন, ‘গোপীবাগের পুরো ঘটনাটি বিএনপির সাজানো ও পূর্বপরিকল্পিত। দলটির ক্যাডাররা আগে থেকেই তৈরি ছিলেন। বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক নিজেই অন্যদের গায়ে হাত তুলছেন, আক্রমণমুখী এবং মারতে যাচ্ছেন, তার প্রমাণ আছে। আমাদের সেখানে ছিল ৫০ থেকে ৬০ জন। আর তাদের ছিল প্রায় ৫০০ জন। এদের সংগ্রহ করে নিয়ে এসে আক্রমণ করা রীতিমতো পরিকল্পনার ব্যাপার।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক একটি ভিডিও ফুটেজ সাংবাদিকদের দেখান। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যালয়ে বিএনপি হামলা করেছে। পরাজয় নিশ্চিত জেনেই এটা করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, বি এম মোজাম্মেল হক, বিপ্লব বড়ুয়া, রিয়াজুল কবির কাওসার প্রমুখ।

পরিবেশ ফিরবে, সেই বিশ্বাস নেই বিএনপির
বিএনপির প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বেরিয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আচরণবিধির এমন কোনো বিষয় নেই, যা সরকারপক্ষ ভাঙছে না। নির্বাচনে সরকারের মন্ত্রী-সাংসদদের সংশ্লিষ্টতা একেবারে পরিষ্কার। এভাবে যদি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত চলে, এটা কি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) হতে পারে? মাইকিং করার সময়সীমা মানা হচ্ছে না। গানবাজনা চলছে, কিছুই মানছে না। আইন না মানার যে প্রবৃত্তি, নির্বাচনের দিন তারা যে বেরিয়ে আসবে, তা ভাবার কারণ নেই। নির্বাচনের দিন এটা হঠাৎ পরিবর্তন হবে তা বিশ্বাস করার কারণ নেই।

আ. লীগ ও বিএনপি
আ. লীগ ও বিএনপি

গোপীবাগের সংঘর্ষের বিষয়ে আমীর খসরু বলেন, ‘প্রথমে আপনাকে মারবে, আবার আপনার বিরুদ্ধে মামলা দেবে, এটা তো এখন বাংলাদেশের নতুন নিয়ম।’ মেয়র প্রার্থী ইশরাকই হামলা করেছেন—আওয়ামী লীগের এমন অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশে যে পরিবেশ, অবস্থা, রাজনীতি চলছে, দখলদারত্ব, খবরদারি চলছে, তাতে বিএনপি আওয়ামী লীগের ওপর হামলা করেছে—দেশের কোনো মানুষ কি তা বিশ্বাস করবে?

বিএনপির এই নেতা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ফুটপাত ও রাস্তার ওপর শ খানেক নির্বাচনী কার্যালয় করেছে। ইসির দায়িত্ব এগুলো ভেঙে দেওয়া। পুনরায় করলে জরিমানা করার কথা। এরপর প্রার্থিতা বাতিল করার নিয়ম। কিন্তু কিছুই করছে না ইসি।

বিএনপির প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ, মো. শাহজাহান, আবদুস সালাম প্রমুখ।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, সংঘর্ষ ও আচরণবিধি লঙ্ঘন করাই হয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—সবই ইসির অধীনে। এরপরও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, ইসি চরম পক্ষপাতদুষ্ট অথবা অদক্ষ। ইসির ওপর দেশের শান্তি-অশান্তি বহুলাংশে নির্ভর করে। তাই তাদের সেভাবেই দায়িত্ব পালন করা উচিত।