দেশেই তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল পাল্লা

আমদানিনির্ভরতা কাটাতে দেশেই অত্যাধুনিক ডিজিটাল স্কেল বা পাল্লা উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। মানসম্মত পণ্যও উৎপাদিত হচ্ছিল। কিন্তু সেসব পণ্য বাজারে তেমন বিক্রি হচ্ছিল না। লোকসান হওয়ায় কারখানার কর্মীদের বেতনও অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। হতাশার এই চিত্র পাল্টে যায় প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর।

গল্পটা উদ্যোক্তা সৈয়দ আহম্মদ কিরণ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান শোভা অ্যাডভান্সড টেকনোলজিস লিমিটেডকে নিয়ে। বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকায় কারখানাটির অবস্থান। ২০১০ সাল থেকে এখানে ‘সুমো ডিজিটাল স্কেল’ নামে পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এ বিষয়ে ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘বগুড়ায় তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল স্কেল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।

প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছর দুয়েক আগেও দেশে সঠিক ওজন মাপার ডিজিটাল স্কেল তৈরির কথা অজানা ছিল। ভোক্তাদের নির্ভরতা ছিল আমদানি করা ডিজিটাল স্কেলে। আবার দেশে স্কেল উৎপাদন করেও ভালো বাজার না পাওয়ায় লোকসানে ছিলাম। দায়-দেনা করে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেও ব্যবসা ভালো না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর দেশের নামীদামি কোম্পানি থেকে ফোন আসতে থাকে। ছোট-বড় মাপের স্কেল কেনার চাহিদা আসা শুরু হয়।’

দাঁড়িপাল্লা থেকে ডিজিটাল স্কেল

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওজন পরিমাপে দেশে প্রাচীন আমল থেকেই ব্যবহৃত আসছে দাঁড়িপাল্লা ও বাটখারা। ওজন পরিমাপে দাঁড়িপাল্লার জায়গাটি দখল করে নিয়েছে এখন ডিজিটাল স্কেল। দেশে যন্ত্রটির বাজার দীর্ঘদিন চীন, কোরিয়া, ভারত ও তাইওয়ানের দখলে ছিল। বর্তমানে এই পণ্য দেশেই তৈরি হচ্ছে। সেই কাজ করছে শোভা অ্যাডভান্সড টেকনোলজিস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় হরেক রকমের ডিজিটাল স্কেল তৈরি হচ্ছে। দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি শুরুর অপেক্ষায় আছে। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রার। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮৬ জন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীসহ ২৫০ জনের।

>

ওজন পরিমাপে দাঁড়িপাল্লার জায়গাটি এখন ডিজিটাল স্কেলের দখলে। যন্ত্রটির বাজার আগে চীন, কোরিয়া, ভারত, তাইওয়ানের দখলে ছিল।

বর্তমানে ৩০০ গ্রাম থেকে ২১০ মেট্রিক টন ওজন মাপার ২৫ ধরনের ডিজিটাল পাল্লা তৈরি হচ্ছে। স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাননিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন (আইএসও) ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)।

পরিবেশক থেকে উদ্যোক্তা

সৈয়দ আহম্মদের জন্ম বগুড়ার ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া গ্রামে। বাবা মাহবুবুর রহমান ব্যবসায়ী ছিলেন। সাইপ্রাস থেকে হোটেল প্রশাসনে পড়াশোনা শেষ করে আসা সৈয়দ আহম্মদের স্বপ্ন ছিল, দেশে ফিরে হোটেল-মোটেল ব্যবসা করবেন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে এই ব্যবসায় ছিল মন্দাভাব। তিনি ব্যবসার ভাবনা বাদ দিয়ে কিছুদিন চাকরি করেন একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে। কয়েক মাস পর চাকরি ছেড়ে পাড়ি জমান দক্ষিণ কোরিয়ায়।

সৈয়দ আহম্মদ সম্প্রতি নিজ কারখানায় সেই সময়ের গল্প বলছিলেন, ‘সাত মাস পর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। হাতে বেতনের সামান্য পুঁজি। ভাবলাম, কোরিয়া থেকে কিছু একটা কিনে নিয়ে গিয়ে দেশে ব্যবসা করব। কিন্তু অল্প টাকায় তেমন কিছু জুটল না। কিনলাম সুইট বিন স্টিক (প্যাকেটজাত গুড়ের কটকটি) বানানোর যন্ত্র। দেশে ফিরে সুইট বিন স্টিক তৈরি করে বাজারজাত করার উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু গুড় মেশানোর কারণে প্যাকেটজাত পণ্যে পিঁপড়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে। প্যাকেট ফুটো করে দেওয়ায় বাজারজাতের আগেই পুঁজি হারাতে হয়। হতাশ হয়ে কিছুদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকলাম। এরপর নামীদামি ব্র্যান্ডের ভোগ্যপণ্য, প্রসাধনীসহ নানা পণ্য পরিবেশকের ব্যবসা শুরু করলাম। এভাবে শোভা এন্টারপ্রাইজ নামে ট্রেডিং ব্যবসা শুরু হলো।’

কর্মচারীদের সঙ্গে শোভা অ্যাডভান্সড টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ কিরণ। গতকাল বিকেলে। ছবি: সোয়েল রানা
কর্মচারীদের সঙ্গে শোভা অ্যাডভান্সড টেকনোলজিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ কিরণ। গতকাল বিকেলে। ছবি: সোয়েল রানা

উদ্যোক্তা সৈয়দ আহম্মদের গল্প এগিয়ে চলে। গল্পে গল্পে তিনি জানান, ২০০৮ সালে বাজার থেকে বাসার জন্য ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা পেঁয়াজ কেনেন তিনি। বাসায় নেওয়ার পর মেপে দেখেন, দুই কেজি কম। তিনি নিশ্চিত হলেন, বাটখারার কারণেই ওজনে এ কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। এবার তাঁর মাথায় সঠিক ওজন মাপার যন্ত্র আমদানির ভাবনা এল।

 চীন ও কোরিয়ায় গিয়ে ডিজিটাল স্কেল দেখে আমদানির সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৯ সালে ভারত থেকে প্রথমবারের মতো মুদিদোকানে ব্যবহারের জন্য টেবিলটপ ডিজিটাল স্কেল আমদানি শুরু করেন। নিজেই বগুড়া শহরের মিষ্টি, মুদি, তরিতরকারি, মনিহারিসহ বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে এই স্কেল বিক্রি করতেন।

সৈয়দ আহম্মদ বলেন, দাঁড়িপাল্লা ও বাটখারা ছাড়া ডিজিটাল স্কেলে সঠিক ওজন করা সম্ভব, সেটা প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইতেন না। দিনে দিনে ক্রেতাদের বুঝিয়ে কোনোরকমে ডিজিটাল স্কেলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখলেন। ধীরে ধীরে বগুড়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় বিপণন শুরু করলেন। টেবিল টপ স্কেল ছাড়াও ভারত, কোরিয়া, চীন, তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অন্যান্য স্কেল আমদানিও শুরু করলেন।

মেড ইন বাংলাদেশ

আমদানি করা পণ্য বিক্রি করে সন্তুষ্ট ছিলেন না সৈয়দ আহম্মদ। তিনি দেশেই ডিজিটাল স্কেল নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তিনি বলেন, ‘অন্য দেশের পণ্যের বাজার তৈরি করে এভাবে দেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে খুব খারাপ লাগত। ভাবতাম, পণ্যের মোড়কে যদি “মেড ইন বাংলাদেশ” লেখা থাকত!’ যেই ভাবনা সেই কাজ। তখন ডিজিটাল স্কেল তৈরির কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন।

নিজ কারখানায় তৈরি পণ্যের গুণাগুণ তুলে ধরে সৈয়দ আহম্মদ বলেন, আমদানি করা টেবিল টপ স্কেলের কাঠামোতে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। অথচ সুমো ডিজিটাল স্কেল স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। ডিজিটাল স্কেলের যে প্লেটে পণ্য তুলে ওজন পরিমাপ করা হয়, এর চার কোণে চার ধরনের ওজন হতে পারে। সুমো ডিজিটাল স্কেল তৈরির সময় ল্যাবে সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে চার কোণের একক ওজন নিশ্চিত করা হয়। এ কারণে ওজনেও শতভাগ সঠিকতার নিশ্চয়তা থাকে। স্কেলের গুণগত মান নিশ্চিত করার কারণেই বিএসটিআই এবং আইএসও সনদ অর্জন সম্ভব হয়েছে। ডিজিটাল স্কেলের ওজনের সঠিকতা নির্ণয়ের জন্য ১ গ্রাম থেকে ২০ কেজি পর্যন্ত বাটখারা আনা হয়েছে ফ্রান্স থেকে। এ ছাড়া বিএসটিআই অনুমোদিত হরেক রকম বাটখারা দিয়েও ওজন যাচাই করা হয়।