মুদির দোকানে বিক্রি হয় গ্যাস সিলিন্ডার

কক্সবাজার শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক। এই সড়কের মুদির দোকান হারুন এন্টারপ্রাইজের সামনে সারি করে রাখা হয়েছে অর্ধশতাধিক এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার। এখান থেকেই সিলিন্ডার বিক্রি হয় প্রতিদিন।  বাজারঘাটা মসজিদ সড়কের মনোহরির দোকান অর্পা ট্রেডিংয়ের সামনেও সিলিন্ডারের সারি। তারাও একইভাবে বিক্রি করছে সিলিন্ডার। শহর ঘুরে ওষুধ, মুদি, মনোহরিসহ বিভিন্ন দোকানে সিলিন্ডার বিক্রি করতে দেখা গেছে। 

নিয়ম অনুযায়ী, গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি ও মজুত স্থানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতারও। এ ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস লাইসেন্স, জ্বালানি অধিদপ্তরের লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ার বিধানও রয়েছে। কিন্তু এ নিয়ম এখানে মানা হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, খুচরা দোকানে বিক্রির জন্য সর্বোচ্চ ১০টি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা যায়। ১০টির বেশি গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে হলে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক। কিন্তু কক্সবাজার শহরসহ আটটি উপজেলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে সাত শতাধিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে লাইসেন্স আছে মাত্র ১১২টি। উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি দোকান আছে আরও পাঁচ শতাধিক। এগুলোর কোনোটির লাইসেন্স নেই। এসব দোকানে দৈনিক গড়ে ৩ হাজার সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে।

গত বুধবার শহরের প্রধান সড়কের দুই পাশে টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট, আইবিপি সড়ক, কালুর দোকান, তারাবনিয়ারছড়া, রুমালিয়ারছড়া, বাসটার্মিনাল, এন্ডারসন সড়ক, থানা রোড, বদরমোকাম, হাসপাতাল সড়ক, বৌদ্ধমন্দির সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, মুদির দোকান, তেলের দোকান, আবাসিক ভবন, পানের দোকান, ঝুপড়ি, চায়ের দোকান এমনকি ওষুধের দোকানেও অবাধে বিক্রি হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশসহ জনবহুল এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার গুদামজাত করা হয়েছে। 

অধিকাংশ দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই। কিছু দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র  টাঙানো হলেও তা অকেজো ও মেয়াদোত্তীর্ণ। 

কথা হয় হারুন এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে এ দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের কেউ নিষেধ করেনি। গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির বিপরীতে কাগজপত্র আছে কি না তাঁর জানা নেই। 

শহরের এন্ডারসন সড়কে চম্পা এন্টারপ্রাইজেও বিক্রি হচ্ছে বিপুল গ্যাস সিলিন্ডার। এই দোকানের মালিক সিরাজুল ইসলাম কক্সবাজার এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতির সভাপতি। তাঁর চম্পা এন্টারপ্রাইজেও গ্যাস বিক্রির ফায়ার লাইসেন্স নেই। 

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যস্ততার কারণে লাইসেন্স নেওয়া হচ্ছে না। তবে যাবতীয় নিয়ম মেনে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে অন্য কোনো ব্যবসায়ী যেন গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি না করে সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।

সম্প্রতি চকরিয়া পৌরসভার বিভিন্ন হাটবাজার ও সড়ক ঘুরে অবৈধভাবে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে দেখা গেছে। পৌরসভার ওয়াপদা সড়কের পাশে একটি লেপ–তোশকের দোকানের সামনে বিক্রির জন্য রাখা হয় গ্যাস সিলিন্ডার। সিলিন্ডারগুলো রাখা হয়েছে একেবারে সড়কের পাশে একটার ওপর আরেকটা স্তর করে। এ কারণে সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছিল। 

পাশের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও ওষুধ বিক্রির দোকানের সামনেও গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে। ওষুধের দোকানের কর্মচারী মনছুর আলম বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার তাঁদের না। লোকজনের নজর কাড়ার জন্য অন্য কেউ গ্যাস সিলিন্ডারগুলো এখানে রেখেছে।

রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজার সদর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারেও অবাধে বিক্রি হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফে যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি বাড়ছে। 

কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, গত ৩ জানুয়ারি শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১২টি বসতবাড়ি ভস্মীভূত হয়েছে। এ সময় আগুনে পুড়ে দুই মাস বয়সী এক মেয়ে শিশুর মৃত্যু হয়েছে। 

১৯ ডিসেম্বর মহেশখালীর কালারমারছড়ায় গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আইয়ুব আলী (৩২) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তাঁর বাড়ি ওই ইউনিয়নের অফিসপাড়ায়। 

পুলিশ ও ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, গত তিন মাসে জেলায় ১০টির বেশি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় ৫ জন নিহত ও অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে।  

কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক শাহাদাত হোসেন বলেন, জেলায় কতটি দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হয়—তার তথ্য জানা নেই। তবে অন্তত ১১২টি দোকানে ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স রয়েছে। 

বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, জনবল সংকটের কারণে তাঁরা জেলা পর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি তদারকি করতে পারছেন না। পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার দায়িত্বে রয়েছেন তিনিসহ মাত্র দুজন কর্মকর্তা। তারপরও মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হচ্ছে।