র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়েও দেশে লিঙ্গবৈষম্য বেড়েছে

চারটি প্রধান সূচকের ভিত্তিতে বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এর মধ্যে তিনটি সূচকেই আগের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান বেশ পিছিয়েছে, অর্থাৎ দেশে লিঙ্গবৈষম্য বেড়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে স্কোর বাড়ার কারণে অবশ্য সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে ২০২০ ও ২০০৬ বিশ্লেষণে এই তথ্য উঠে এসেছে। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন—চারটি প্রধান সূচকে প্রতিটি দেশের লৈঙ্গিক বৈষম্য দেখা হয়। এতে দেখা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বাদে প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ ২০০৬ সালের তুলনায় কম স্কোর করেছে। অর্থাৎ, কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি লাভ করলেও মোটাদাগে নারী-পুরুষের সমতার চিত্র খারাপ হচ্ছে।

নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৫০তম অবস্থানে রয়েছে। অথচ ২০০৬ সালে অবস্থান ছিল ৯১তম। এই প্রতিবেদনে ১৫৩টি দেশের মধ্যে নারী-পুরুষের সমতার চিত্র দেখা হয়েছে।

এ বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, র‌্যাঙ্কিং দেখে দেশে লিঙ্গবৈষম্য কমেছে ভাবার কারণ নেই, বরং বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। আরেকটু সূক্ষ্মভাবে দেখলে বোঝা যাবে, দিন দিন নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের পথে চ্যালেঞ্জ বেড়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বৈষম্য বাড়ছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও নারীরা অনেক বেশি অবহেলিত।

রাশেদা কে চৌধূরী আরও বলেন, সরকারপ্রধান নারী বাদে নারী ক্ষমতায়নেও তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ, সংসদে বা দলীয় পর্যায়ে নেতৃত্বে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ এখনো নারীদের ক্ষমতায়নের চিত্র প্রকাশ করছে না।

>

বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন। কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগতি লাভ করলেও মোটাদাগে নারী-পুরুষের সমতার চিত্র খারাপ হচ্ছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে চারটি সূচকের অধীনে আবার ১৪টি উপসূচক রয়েছে। উপসূচকের মধ্যে চারটি উপসূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশের ওপরে স্থান পেয়েছে। ক্ষেত্রগুলো হলো, ছেলে ও মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়েদের সমতা, জন্মের সময় ছেলে ও মেয়েশিশুর সংখ্যাগত সমতা ও সরকারপ্রধান হিসেবে কত সময় ধরে একজন নারী রয়েছেন। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ নারী–পুরুষের সমতায় শীর্ষে রয়েছে।

যে তিন সূচকে পিছিয়েছে

নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু—এই তিন সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান বেশ পিছিয়েছে। অর্থাৎ, গত ১৪ বছরে এই তিন ক্ষেত্রেই দেশে লিঙ্গবৈষম্য বেড়েছে।

নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ শীর্ষক সূচকে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১, যা ২০০৬ সালে ছিল ১০৭। আবার এই সূচকের অধীনে পাঁচটি উপসূচকেই লিঙ্গবৈষম্য বেড়েছে। মজুরির সমতার সূচকে দেশের অবস্থান ৯৮তম। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, পেশাদার ও প্রায়োগিক কর্মীর সূচকে ১৩০–এর পরে দেশের অবস্থান।

শিক্ষায় অংশগ্রহণ সূচকের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ভর্তির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে ১ নম্বর। তবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে নারীরা প্রকট বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, এই উপসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান শেষের দিকে।

স্বাস্থ্য ও আয়ু—এই সূচকে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯। এই সূচকে ২০০৬–এ আরও ভালো অবস্থানে ছিল।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে এগিয়ে

নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। দীর্ঘসময় ধরে (গত ৫০ বছরে) সরকারপ্রধান হিসেবে নারী থাকার রেকর্ডও বাংলাদেশের। তবে পার্লামেন্টে নারীর অংশগ্রহণের উপসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৬ এবং মন্ত্রীর সংখ্যার হিসাবে ১২৪।

চলমান সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে তাকালেই এর সত্যতা মেলে। ঢাকার দুই সিটির ১২৯টি সাধারণ ওয়ার্ডে মাত্র ৬ জন নারী প্রার্থী দলীয় সমর্থন পেয়েছেন। এর মধ্যে ২ জন আওয়ামী লীগের, বিএনপির ৪ জন। এবার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো নারী মেয়র প্রার্থীও নেই।

বড় দুই দলের প্রার্থীসহ এবার সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৮ জন নারী। এর আগে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দুই সিটির সাধারণ ওয়ার্ডে নারী প্রার্থী ছিলেন ২৩ জন। সে হিসাবে এবার নারী প্রার্থীর সংখ্যা কমেছে। যদিও গত নির্বাচনের চেয়ে এবার ওয়ার্ড বেড়েছে ৩৬টি।

নারীদের রাজনীতিতে আগ্রহ কমে যাচ্ছে উল্লেখ করে বেসরকারি সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির প্রথম আলোকে বলেন, নারীদের রাজনীতিতে আসাই বড় চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পরেও নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ কম এবং মতামতের গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। তার ওপর নিরাপত্তা ও পরিবেশও বড় বাধা। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে আন্তরিকতারও ঘাটতি রয়েছে।