ঝরে পড়াদের নৈশ বিদ্যালয়

রংপুরের মেয়ে রুমা জান্নাত (১৯)। চাকরি করেন গাজীপুরের টঙ্গীর একটি পোশাক কারখানায়। তাঁর স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি না পেরোতেই ধাক্কা লাগে সেই স্বপ্নে। মা-বাবা আর তিন বোনের সংসারে হঠাৎ দেখা দেয় দারিদ্র্য। পরিবারের হাল ধরতে লেখাপড়া ছেড়ে যোগ দিতে হয় চাকরিতে।

কিন্তু রুমা থেমে যেতে চান না। সংসারের টানাপোড়েনে চাকরিতে যোগ দিলেও তাঁর মন পড়ে ছিল পড়াশোনায়। মনে মনে খুঁজতেন শিক্ষার সুযোগ। এর মধ্যেই এক বান্ধবীর মাধ্যমে খবর পেলেন একটি নৈশ বিদ্যালয়ের, যেখানে চাকরিজীবীদের পড়ানো হয়। কালক্ষেপণ না করে রুমা ভর্তি হন সেখানে। সারা দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বই-খাতা নিয়ে ছোটেন বিদ্যালয়টিতে। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়টি থেকে জেএসসি পাস করেছেন। আগামী বছর অংশ নেবেন এসএসসি পরীক্ষায়।

ভোলার লালমোহন উপজেলার মো. রিপন হোসেনের গল্পটাও একই রকম। সৎমায়ের সংসারে দিন কেটেছে খেয়ে, না খেয়ে। সংসারের অনটনে দ্বিতীয় শ্রেণির পর তারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের হাল ধরতে টঙ্গীতে এসে তিনিও যোগ দেন চাকরিতে। বর্তমানে তিনিও এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। টানা ১০ বছর পর আবার শুরু করেছেন পড়াশোনা। পড়ছেন তৃতীয় শ্রেণিতে।

রুমা ও রিপনের মতো হোসনা, মহিদুল, শ্যামল, সুমন, তানিয়া, ফারিয়া, সোহেলসহ অনেক পোশাকশ্রমিকের পড়াশোনায় ফেরার গল্প গাজীপুরের টঙ্গীর। যুবরাজ শামীম নামের এক তরুণ নিজ উদ্যোগে শুরু করেছেন একটি রাতের পাঠশালা, সেখানে পড়ছেন বিভিন্ন কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া চাকরিজীবী, শিশু-কিশোর।

বিদ্যালয়টির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আমাদের নৈশ বিদ্যালয়’। ২০১৪ সালের ১ জুন এটি শুরু হয়। এটি টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় অবস্থিত। এর নিজস্ব কোনো ভবন নেই। পাঠদান চলে স্থানীয় পাগাড় মোহম্মদ আলী উচ্চবিদ্যালয়ে। ক্লাস শুরু হয় রাত আটটায়। চলে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। পাঁচটি কক্ষে বিন্যস্ত করে পাঠদান চলে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। আর বিদ্যালয়টির নিজস্ব রেজিস্ট্রেশন না থাকায় শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন পাগাড় মোহম্মদ আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে।

বিদ্যালয়টি শুরু হয়েছিল চারজন শিক্ষার্থী নিয়ে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০০। শিক্ষার্থীদের সবাই বিভিন্ন পোশাক বা কলকারখানার শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত ক্লাসে অংশ নেন ৭০ থেকে ৮০ জন। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়টি থেকে ৩৪ জন জেএসসি ও সাতজন এসএসসি পাস করেছেন। এবার জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন নয়জন। আর এসএসসি পরীক্ষা দেবেন ১১ জন। এর বাইরেও বিদ্যালয়টির রয়েছে একটি পাঠাগার। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা চলে বইপড়া কার্যক্রম।

পাঠদানের জন্য পাগাড় মোহম্মদ আলী উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কোনো ভাড়া হয় না। তবে পাঠাগার আর নৈশ বিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া শিক্ষকদের যাতায়াত ভাড়া বাবদ কিছু সম্মানী দিতে হয়। শামীম চাকরি করে আগে সে খরচ নিজেই বহন করতেন। কিন্তু হঠাৎ চাকরি চলে যায় শামীমের। সংকটে পড়ে বিদ্যালয় ও পাঠাগারের কার্যক্রম। পরবর্তী সময়ে পরিচিতজনদের মধ্য থেকে কয়েকজন দাতা খুঁজে বের করেন তিনি। তাঁদের মধ্যে বর্তমানে ১৯ জন বন্ধু মাসিক ১০০ টাকা ও একজন ব্যবসায়ী ২০ হাজার টাকা হারে চাঁদা দেন। এই দিয়েই চলছে বিদ্যালয় ও পাঠাগারের কার্যক্রম।

সম্প্রতি সন্ধ্যার পর বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, শিশু-কিশোরেরা মূল ফটকের সামনে খেলাধুলা করছে। বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা একেক করে আসছেন বিদ্যালয়ে। কারও হাতে বই-খাতা, কারও হাতে টিফিন বক্স। কারও কারখানা দেরিতে ছুটি হওয়ায় বিদ্যালয়ে আসতে দেরি হচ্ছে। স্কুলের বারান্দায় কথা হয় রুমা জান্নাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি লেখাপড়া করে আমার স্বপ্নকে ছুঁতে চাই।’ মহিদুল নামের একজন শ্রমিক বলেন, ‘লেখাপড়ার কোনো বয়স নাই। আমার স্ত্রী প্রথম প্রথম রাগ করলেও এখন সে উৎসাহ দেয়।’ এবার জেএসসি পাস করেছেন হোসনা আক্তার (১৮)। তিনি বলেন, ‘স্যারদের, (কারখানা কর্তৃপক্ষ) অনেক অনুরোধ করেছিলাম পরীক্ষার আগে কয়টা দিন ছুটি দেওয়ার জন্য। কিন্তু স্যাররা ছুটি দেয় নাই। তাই বাধ্য হয়ে চাকরিই ছেড়ে দিছি।’

বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কথা হলে তিনি বলেন, এখানে প্রত্যেক শ্রমিক সারা দিন কাজ শেষে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তবু তাঁরা ক্লাস বাদ দেন না।

শামীমের বাড়ি টঙ্গী বিসিকের পাগাড় এলাকায়। পড়াশোনা শেষে এখন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি বিদ্যালয়টিতে ক্লাস নেন ও দেখাশোনা করেন। আগে শুধু বন্ধুরা মিলে বিদ্যালয়টিতে পড়াতেন। বর্তমানে শিক্ষার্থী বাড়ায় কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে পাঠদানের জন্য নেওয়া হয়েছে।

শামীম বলেন, ‘মাঝে কয়েকবার চাকরির সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই স্কুলের মায়ায় এসব চাকরিতে যোগ দেওয়া হয়নি। স্কুল ও আমাকে এখন আর আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এখানে পড়তে আসা প্রত্যেক শ্রমিক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।’