১০০ বছর পর হাওরের তিন থানা পেল গাড়ি

হাওরের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম থানা পেয়েছে গাড়ি। গত সোমবার বিকেলে মিঠামইন থানা প্রাঙ্গণে গাড়িগুলো কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।  ছবি: প্রথম আলো
হাওরের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম থানা পেয়েছে গাড়ি। গত সোমবার বিকেলে মিঠামইন থানা প্রাঙ্গণে গাড়িগুলো কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ছবি: প্রথম আলো

মাসখানেক আগে হাওর–অধ্যুষিত ইটনা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল রাইটুটি এলাকায় ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। রাত ১০টার দিকে ভুক্তভোগী নারী নিজেই থানায় অভিযোগ নিয়ে হাজির। অভিযোগ পেয়ে থানার ওসির নেতৃত্বে একদল পুলিশ দোষী ব্যক্তিদের ধরতে অভিযান চালায়। কিন্তু পানিপথে নৌকায় আসামি ধরতে গিয়ে রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায়। ইতিমধ্যে অপরাধীরাও এলাকা থেকে সটকে পড়ে। যদি গাড়ি নিয়ে সড়কপথে যাওয়া যেত, তাহলে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছানো যেত। আসামিদেরও ধরা যেত।

এ অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ইটনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান। তিনি বলেন, এ রকম একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনায় আসামি ধরতে না পারায় সেদিন তাঁর খুব খারাপ লেগেছিল। এখন মুঠোফোনের সুব্যবস্থা থাকায় কোনো সংঘর্ষ বা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার খবর খুব সহজেই তাঁদের কাছে চলে আসে। কিন্তু যোগাযোগ বেহাল হওয়ার কারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই হতাহতের ঘটনাসহ অনেক দুর্ঘটনা বা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে যায়। অথচ গাড়ির সুবিধা থাকলে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে অনেক ঘটনা থামানো যেত।

হাওরের অনেক জায়গায় নৌকা বা স্পিডবোটেও পৌঁছানো যায় না। সেসব এলাকা থেকে আসামি ধরে অনেক ঝুঁকি নিয়ে একই মোটরসাইকেলে করে থানায় নিয়ে আসা হতো। যে পুলিশ সদস্য মোটরসাইকেলে বসিয়ে আসামি নিয়ে আসতেন, তিনিও খুব ভয়ে থাকতেন। অথচ গাড়ির সুবিধা থাকলে একসঙ্গে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আসামিদের ধরতে যেতে পারতেন—মন্তব্য ওসি মুর্শেদ জামানের।

১৯১৭ সালে ইটনা থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম থানাও প্রতিষ্ঠিত হয়। কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলার ১০ থানার মধ্যে গাড়ি থাকলেও হাওর অধ্যুষিত তিন উপজেলার তিন থানায় এত দিন গাড়ি ছিল না। কিন্তু এখন গাড়ি মিলেছে। এতে তিন থানার পুলিশ সদস্যরা আনন্দিত। 

হাওরাঞ্চলের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের থানা প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পর গাড়িগুলো মিলল। গত সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ মো. রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক তিন থানার ওসির হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেন। এ উপলক্ষে মিঠামইন থানা প্রাঙ্গণে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদের সভাপতিত্ব করেন।

অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুল ইসলাম, মিঠামইন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আছিয়া আলম, ইটনার চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসান, অষ্টগ্রাম সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার এস এম আজিজুল হক, ইটনার ইউএনও নাফিসা আক্তার, মিঠামইন সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরীফ কামাল, মিঠামইন থানার ওসি মো. জাকির রব্বানী, অষ্টগ্রাম থানার ওসি মো. কামরুল ইসলাম মোল্লা, ইটনার ওসি মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান প্রমুখ।

মিঠামইনের ওসি জাকির রব্বানী জানান, তিনি ২০১৮ সালের শেষ দিকে ভাটি অঞ্চলের এ থানায় যোগদান করেন। এর আগে তিনি উঁচু এলাকায় অবস্থিত  পাকুন্দিয়া, করিমগঞ্জ ও কটিয়াদী থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সেসব থানায় গাড়ির সুবিধা পেলেও মিঠামইনে এসে গাড়ির সুবিধা পাননি। তিনি বলেন, হাওরের একেকটি অঞ্চল দ্বীপের মতো। বেহাল যোগাযোগব্যবস্থার কারণে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গার দূরত্ব অনেক বেশি মনে হয়।

অষ্টগ্রাম থানার ওসি কামরুল ইসলাম বলেন, গাড়ি ছাড়া পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালনে ভীষণ অসুবিধা হতো। অবশেষে গাড়ির সুবিধা পাওয়ায় তিন থানার পুলিশ সদস্যরা খুবই খুশি।

মিঠামইনের ঘাগড়া ও ইটনা সদরের অন্তত ১০ জন বাসিন্দা বলেন, ভাটি অঞ্চলের তিন থানায় গাড়ি আসায় স্থানীয় লোকজন খুব খুশি। এতে পুলিশের দায়িত্বশীলতা ও গতি আগের চেয়ে বাড়বে।

রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, তাঁর বাবা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের স্বপ্ন ছিল হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একদিন গাড়ি চলবে। সে লক্ষ্যে ভাটি অঞ্চলের অবহেলিত মানুষের সুবিধার্থে কয়েক বছর ধরে এসব এলাকার তিন উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৪ কিলোমিটারের মতো ডুবো, আভুরা সড়কসহ বেশ কটি সেতুর কাজ করা হচ্ছে। এর সুফল শুরু হয়েছে পাঁচটি ফেরি চলাচলের মধ্য দিয়ে। ফেরির কারণে তিনিও এখন ঢাকা থেকে গাড়িতে করে সরাসরি বাড়িতে আসতে পারবেন। আর পুলিশ সদস্যরাও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গাড়িতে যেতে পারবেন। 

পুলিশ সুপার বলেন, তিন থানার পুলিশ কর্মকর্তারা নিউ ব্র্যান্ডের তিনটি ডাবল কেবিনের এসি পিকআপ পেয়েছেন। এতে আগের চেয়ে এসব এলাকার পুলিশ কর্মকর্তাদের গতিশীলতা বৃদ্ধিসহ এলাকার অনেক অপরাধ কমে আসবে বলে তাঁর বিশ্বাস।