যৌন হয়রানি প্রতিরোধে শাস্তি দৃশ্যমান করা জরুরি

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মো. মুজিবুল হক। পাশে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মো. মুজিবুল হক। পাশে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। ছবি: প্রথম আলো

কর্মস্থলে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হলেও চাকরি হারানো ও লোকলজ্জার ভয়ে তাঁরা বেশির ভাগ সময় চুপ থাকেন বা প্রতিবাদ করেন না। আবার কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলেও অনেক সময় নতুন করে তাঁকে হয়রানির শিকার হতে হয়। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দ্রুত বিচার করে শাস্তি দৃশ্যমান করা জরুরি। একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার।

গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও প্রতিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। প্রথম আলোর আয়োজনে এই গোলটেবিল আয়োজনে যৌথভাবে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা সুইডিশ সিডা।

গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে কর্মস্থলে যৌন হয়রানির ধরনেও পরিবর্তন এসেছে, আবার ব্যাপ্তিও বাড়ছে। ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার ভয়ে বিভিন্ন কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ যৌন হয়রানির ঘটনা চেপে রাখতে চায়।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মো. মুজিবুল হক বলেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দ্রুত বিচার করে শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে। যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে আইন করার বিষয়টি তিনি শিগগিরই সংসদে উত্থাপন করবেন বলে জানান।

এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, কেবল কর্মস্থলে নয়, ঘর, জনসমাগমস্থল, বসবাসসহ সর্বত্র নারীর ওপর নির্যাতন বাড়ছে। কেউ নির্যাতনের প্রতিবাদ করলে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা দরকার।

আইনি প্রতিকার পেতে ভুক্তভোগীকে পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে মন্তব্য করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেন। নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বা কেউ নির্যাতনের শিকার হলে সরকারের হটলাইন ১০৯, ৩৩৩, ৯৯৯ এবং জয় অ্যাপস ব্যবহার করে প্রতিকার পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।

শ্রম আইনের ৩৩২ ধারা অনুযায়ী নারীর প্রতি কেউ বিরূপ আচরণ করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক মো. মতিউর রহমান। তিনি বলেন, অধিদপ্তর সরাসরি শাস্তি দিতে পারে না, কেবল অভিযোগ নিতে পারে। এই সীমাবদ্ধতা কর্মস্থলে নারী নির্যাতন কমাতে একটি বাধা।

গোলটেবিল বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত করার পরামর্শ দেন।

বৈঠকে এমজেএফের জেন্ডার-বিষয়ক উপদেষ্টা বনশ্রী মিত্র নিয়োগী একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রভেদে হয়রানির ধরন বদলে যায়। আবার অনেক নারীর যৌন নির্যাতন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির মতো ভয়ংকর কিছু না হলে অনেকে তা যৌন নির্যাতন বলছেন না।

গোলটেবিল বৈঠকে দুই নারী পোশাকশ্রমিক তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা শোনান। তাঁরা বলেন, কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার সময় তত্ত্বাবধায়ক হাত ধরেন, গায়ে হাত দেন। অনেক সময় শৌচাগারেও যেতে দেয় না। ভয়ে এসব নির্যাতনের প্রতিবাদ করা হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, যৌন নির্যাতনের শিকার হলে একজন নারীর কর্মদক্ষতা হ্রাস পায়, যার নেতিবাচক প্রভাব কেবল ভুক্তভোগী নয়, প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়ে। যৌন নির্যাতন এখনই থামানো না গেলে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কেবল পোশাক খাত নয়, অন্য খাতেও কমে যাবে।

পোশাক খাতে নারী নির্যাতনের কথা তুলে আনতে গিয়ে অন্য খাতগুলো আড়ালে থেকে যাচ্ছে বলে জানান বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ঢাকার প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা শিপ্রা চৌধুরী যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের নীতিমালার আরও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দরকার বলেও জানান।

হয়রানি একজন ব্যক্তির মাধ্যমে হলেও এর দায় প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া রফিক।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের আইনজীবী সিফাত-ই-নূর খানম বলেন, প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়া নারীর প্রতি যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয় যায়, এটি আইনি অধিকার পেতে বড় বাধা।

যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা কেন বাড়ছে, তা নিয়ে বিশদ গবেষণা হওয়া দরকার বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক এম রবিউল ইসলাম।

শ্রমিক থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা পর্যায়—সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি কমে যাবে বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএর যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য রুমানা রশীদ।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের প্রকল্প কর্মকর্তা ইসরাত জাহান, আওয়াজ ফাউন্ডেশনের সভাপতি মমতাজ বেগম, এমজেএফের কর্মসূচি কর্মকর্তা সোমা দত্ত। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।