ঢাকার নির্বাচনে বিএনপির দুশ্চিন্তা ইভিএম

প্রচারে হামলা এবং নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও এখন পর্যন্ত মাঠের পরিস্থিতি যা, তাতে খুব হতাশ নয় বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকেরা আশাবাদী যে মানুষ ঠিকমতো ভোট দিতে পারলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হবেন। এখন তাদের মূল চিন্তা দলীয় পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়া এবং কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানো।

সব ছাপিয়ে বিএনপির নেতাদের মূল দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। তাঁরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ একেকবার একেক কৌশলে ‘ভোট কারচুপি’ করছে। এখন পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের পরিবেশ আগের নির্বাচনের তুলনায় ভালো। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করছে না। এটাও একটা সন্দেহের বিষয়। তাঁদের সন্দেহ, এবারের ভোট কারচুপির কৌশল হতে পারে ইভিএম, যা প্রতিরোধে বিএনপির হাতে পাল্টা কোনো কৌশল নেই।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে যেতে বলেছি। নির্বাচন কমিশন শোনেনি। ইভিএমে ভোট চুরি করা আরও সহজ। তাই মানুষ সন্দিহান যে ইভিএমে কী হয়।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মওদুদ আহমদ স্পষ্ট করেন, ‘যখন তারা (আওয়ামী লীগ) দেখবে ভোটে জিতবে না, তখন তারা মেশিনের আশ্রয় নেবে। সেভাবেই প্রোগ্রামিং করবে। এবার মেশিনের নির্বাচন হবে বলে আমরা ভয় করছি। তবু আমরা আশাবাদী। মানুষ যদি ঠিকভাবে ভোট দিতে পারে, তাহলে মেশিনেও কাজ হবে না।’

খন্দকার মোশাররফ ঢাকা দক্ষিণ এবং মওদুদ আহমদ উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক।

>দুই সিটিতে দলীয় পোলিং এজেন্ট ঠিক করা, কেন্দ্র পাহারা এবং ভোটার সংগ্রহের দিকে বিশেষ নজর।

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়লে তা বিএনপির জন্য অনুকূল হবে। তাই ভীতি সৃষ্টি করে ভোটার উপস্থিতি কমানো, সেই সঙ্গে বিএনপির এজেন্টরা যাতে ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারেন, সে জন্য ক্ষমতাসীনেরা প্রশাসনের সহায়তায় এবারও পুরোনো কৌশলগুলো নিতে পারে। এসব বিবেচনা থেকেই বি​এনপির দুই মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন প্রচারের শুরুর দিন থেকেই জোর দিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে, নেতা-কর্মীদের সাহস নিয়ে মাঠে থাকতে বলছেন।

তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, তাতে বিএনপির নতুন করে হারানোর কিছু নেই। বরং রাজধানীকেন্দ্রিক এই নির্বাচন থেকে বিএনপির রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের অনেক সুযোগ আছে। তাঁরা মনে করেন, মাঠের যে পরিস্থিতি, সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হবেন। তা ছাড়া আগের রাতে ভোট নেওয়া বা মেরেকেটে এজেন্টদের বের করে দেওয়া এত সহজ হবে না। সে জন্য দুই সিটিতে দলীয় পোলিং এজেন্ট ঠিক করা, কেন্দ্র পাহারা এবং ভোটার সংগ্রহের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

নির্বাচনী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এই নির্বাচনে তাঁরা মোটামুটি দুটি কাজ করতে পেরেছেন। তা হচ্ছে, দীর্ঘদিন পর বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের ঘর থেকে মাঠে নামানো গেছে। সেই সঙ্গে ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে অনীহা তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা কেটেছে। কারণ, বিনা ভোটে বর্তমান সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়া বা আগের রাতে ভোট চুরিসহ ক্ষমতাসীনদের কাণ্ডকীর্তিতে মানুষ ভোটবিমুখ হয়ে পড়েছে। বিএনপির প্রার্থীদের প্রচারণা মানুষের মধ্যে আশা জাগিয়েছে যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হতেও পারে। এখন তাঁরা উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ভোট দিতে যাবেন। কিন্তু শেষ অবধি যদি ভোটের পরিবেশ না থাকে বা মানুষ ভোট দিতে না পারে, তা বিএনপির পক্ষেই যাবে।

সিটি নির্বাচন ঘিরে নেতা-কর্মীদের রাস্তায় নামাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক মনে করেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারে নিজের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের প্রবল ইচ্ছা ভোট দেওয়ার। মানুষ জানতে চাইছে ভোট দিতে পারবে কি না। আমরা বলেছি, আপনারা ভোট দিতে যাবেন। এখন ভোট দিতে পারবে কি পারবে না, আমরা সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি।’

তবে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে দলীয় ঐক্য এবং কারাবন্দী চেয়ারপারসনের মুক্তির আওয়াজ জোরেশোরে তুলতে পারা। এ ছাড়া বিতর্ক ছাড়াই বিএনপি দুই সিটিতে​ মেয়র পদপ্রার্থী দিতে পেরেছে, যাঁদের যোগ্যতা নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। এ নির্বাচন ঘিরে নেতা-কর্মীদের বিরোধও কমেছে, যা দলের ভেতরে-বাইরে আশার সঞ্চার করেছে।

আবদুস সালাম নামের বিএনপির এক সমর্থক গত সোমবার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ঘণ্টাখানেক ধরে মির্জা আব্বাস হাঁটছেন ইশরাককে নিয়ে। এই ঐক্য, সহকর্মীর সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা কি আমরা দেখতে পারতাম নির্বাচনে বিএনপি না এলে? রাজপথে হাজারোজনের প্রতিদিনের মিছিল কি সম্ভব হতো? প্রতিদিন কি খালেদা জিয়ার মুক্তির আওয়াজ তুলতে পারতাম?’

গতকাল মঙ্গলবার ধানমন্ডির ২৭ নম্বর থেকে হাতিরপুল পর্যন্ত দক্ষিণের মেয়র পদপ্রার্থী ইশরাক হোসেনের প্রচারণায় ছিলেন ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল ​এলডিপির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, এ নির্বাচনে বিএনপির বড় ধরনের প্রাপ্তি হচ্ছে নেতা-কর্মীদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া। বাসাবাড়ির জানালা থেকে কীভাবে হাত নাড়ল, একটি ছোট মিছিলে কীভাবে ধীরে ধীরে এত বড় হয়ে গেল, তা দেখলাম।’

বিএনপির দুই মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন বয়সে তরুণ এবং উচ্চশিক্ষিত। পিতৃপরিচয়ের কারণেও তাঁরা আলোচিত। তাবিথের বাবা আবদুল আউয়াল মিন্টু দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। ইশরাকের বাবা প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা ঢাকার মেয়র এবং বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ​ছিলেন। তাবিথ এবারসহ দুবার নির্বাচন করলেও ইশরাক এবারই প্রথম।

বি​এনপির নেতারা বলছেন, দুজনের জন্যই ঢাকার এ নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুজনেই গত ১৯ দিনের বিরামহীন গণসংযোগে একটা সাড়া ফেলতে পেরেছেন। এখন তাঁরা মেয়র হতে পারবেন কি না বা না পারলেও দলীয় রাজনীতিতে নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করার সুযোগ রয়েছে। এ নির্বাচনে তারও একটা পরীক্ষা হবে।

বি​এনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনী মাঠে হাজারো প্রতিকূল অবস্থা, নির্বাচন কমিশনের অক্ষমতা, ক্ষমতাসীন দলের অবারিত আচরণবিধি লঙ্ঘন, নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা, ভয়ভীতি দেখানো—তা সত্ত্বেও যদি সত্যিকার নির্বাচন হয়, যদি মানুষ ভোট দিতে পারে, এজেন্টরা যদি কেন্দ্রে থাকতে পারেন, তাহলে দুই সিটিতেই ধানের শীষের প্রার্থী বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।’