ঢাকার টাইফয়েড ওষুধপ্রতিরোধী
ওষুধপ্রতিরোধী রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গর্ডন ডোগান। তাঁর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ঢাকা শহরে টাইফয়েডের জীবাণু ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ঢাকার শিশুস্বাস্থ্য গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রধান অধ্যাপক সমীর সাহার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার সমাধান পাওয়া যেতে পারে টাইফয়েড টিকার ব্যবহারের মাধ্যমে। ঢাকায় টাইফয়েড যে ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠছে, সে বিষয়ে দুজনের পর্যবেক্ষণ প্রায় একই।
দুই দেশের দুই বিশেষজ্ঞ টাইফয়েড ও টিকা নিয়ে নিজ নিজ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন ডায়রিয়াজনিত রোগ ও পুষ্টিবিষয়ক ১৫তম এশীয় সম্মেলনে (অ্যাসকড)। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে শুরু হয়েছে তিন দিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এই সম্মেলনের আয়োজক। সম্মেলনে আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার খুব শিগগির দেশে কলেরা, টাইফয়েড, এইচপিভি ও রোটাভাইরাসের টিকার ব্যবহার শুরু করতে যাচ্ছে।
টাইফয়েডে টিকা
গর্ডন ডোগান তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে টাইফয়েডের জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে, সম্মেলনে তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। ১৯৯৫ সালে ভিয়েতনাম কীভাবে ওষুধপ্রতিরোধী টাইফয়েড নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল, সে উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে টাইফয়েডের জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতি পুরো বাংলাদেশেও হতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে।
আর অধ্যাপক সমীর সাহা সম্মেলনের আরেকটি অধিবেশনে বলেন, একসময় টাইফয়েডে আক্রান্তদের ৩০ শতাংশ মারাই যেত। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর মৃত্যু কমেছে। কিন্তু এখন অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে টাইফয়েডের ক্ষেত্রে। পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কাও অমূলক নয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ টিকার ব্যবহার। তিনি বলেন, টিকার মাধ্যমে টাইফয়েড প্রতিরোধ করা সম্ভব, এমনকি নির্মূলও করা সম্ভব।
টাইফয়েড পানিবাহিত রোগ। এর জীবাণু মানুষ ছাড়া অন্য কারও শরীরে থাকে না।
সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে মূলত জোর দেওয়া হয়েছিল টাইফয়েডের ওপর। এসব অধিবেশনে বলা হয়, টাইফয়েড জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী হয়ে ওঠা সারা বিশ্বের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাইফয়েডের টিকা নিয়ে কোথায় কী গবেষণা হচ্ছে, কোথায় কোথায় পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে, কবে নাগাদ কী টিকা ব্যবহার করা যাবে, তা নিয়ে একটি অধিবেশনে আলোচনা করেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনড্রো জে পোলার্ড।
একই অধিবেশনে টাইফয়েড নিয়ন্ত্রণে বহু খাতভিত্তিক সমাধানের ওপর জোর দেন সুইজারল্যান্ডের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের টিকা বিশেষজ্ঞ এডোয়া বেন্টসি এন্সিল। তিনি বলেন, টাইফয়েডের সঙ্গে দারিদ্র্য, শিক্ষা ও সচেতনতা, বিশুদ্ধ পানি, নিরাপদ খাদ্য, জনঘনত্ব এবং অভিবাসনের সম্পর্ক আছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পয়োব্যবস্থার উন্নতি করে টাইফয়েডের প্রকোপ কমানো সম্ভব।
সকালে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বাংলাদেশে নানা ধরনের টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে টিকাদান পদ্ধতিরও উন্নতি হয়েছে।
স্বাগত বক্তব্যে আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও অ্যাসকডের সভাপতি ফেরদৌসী কাদরি বলেন, এই সম্মেলনে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে দেশের নবীন বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাবেন।
আইসিডিডিআরবির জন্ম ও ৬০ বছরের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও গবেষণা এবং বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক স্বাস্থ্যে তার প্রভাব নিয়ে বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ডন ডি ক্লেমেন্স।
সংক্রমণ প্রতিরোধ
বিকেলের একটি অধিবেশনে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সামগ্রিক ও সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয়। আইসিডিডিআরবির পরামর্শক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, নতুনভাবে উদ্ভূত সংক্রামক ব্যাধির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের উৎপত্তি জীবজন্তু বা পশুপাখি থেকে।
আইসিডিডিআরবির অন্য জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মোস্তাফিজুর রহমান চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, জাপানে এই ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ায় এমন ভাইরাসের সঙ্গে নতুন করোনাভাইরাসের মিল আছে।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নিতীশ দেবনাথ বলেন, মানুষ, পরিবেশ এবং প্রাণীর স্বাস্থ্যকে সমান গুরুত্ব দিলেই মানুষ ভালো থাকবে।
সম্মেলন আয়োজনে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, ওষুধ কোম্পানি ইনসেপ্টা, স্কয়ারসহ দেশি–বিদেশি ১০টি প্রতিষ্ঠান। সম্মেলন আয়োজনে সহায়তা করেছে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সুইডিশ সিডা। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪৫০ বিজ্ঞানী, গবেষক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন। এর মধ্যে ১৭টি দেশ থেকে এসেছেন ৮১ জন।