দেশের প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা হবে ডিএসসিসি: তাপস

নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। ছবি: আবদুস সালাম
নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। ছবি: আবদুস সালাম

ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকা—এমন পাঁচটি রূপরেখা দিয়ে নিজের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেছেন, ‘ডিএসসিসি হবে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম দুর্নীতিমুক্ত সংস্থা।’ পাঁচ রূপরেখা ছাড়া ইশতেহারের অধিকাংশজুড়ে রয়েছে দক্ষিণ সিটিতে গত ১১ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ।

আজ বুধবার দুপুরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন শেখ ফজলে নূর। এরপর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো কর না বাড়িয়ে দুই বছরের মধ্যে ডিএসসিসি স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। সংস্থার টাকায় সব ব্যয় বহনের পাশাপাশি নেওয়া হবে উন্নয়ন প্রকল্প। সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে নগরে ডিএসসিসির অভিভাবকত্ব নিশ্চিত করা হবে।

পাঁচ দফা রূপরেখা অনুসারেই ৩০ বছরের মহাপরিকল্পনা তৈরি করে বিভিন্ন মেয়াদে তা বাস্তবায়ন করা হবে। তবে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অধিকাংশ প্রকল্প শেষ করা হবে বলেও জানান তিনি। আগামী ১ ফেব্রুয়ারির ভোটে জয়ী হতে সবার আস্থা ও সমর্থন চান তিনি।

ঐতিহ্যের ঢাকা
ডিএসসিসির আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বলেন, ‘৪০০ বছরের পুরোনো আমাদের এই ঢাকার রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্যের উজ্জ্বল ছবি, ঐতিহ্যের গভীর শিকড় ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব। পর্যটনের জন্য ঢাকা হতে পারে অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র। এখানে ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ অনন্য। সাংস্কৃতিক ধারায় রয়েছে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, পয়লা বৈশাখ, ঘুড়ি উৎসব, চৈত্রসংক্রান্তিসহ অজস্র উৎসব। আমি নির্বাচিত হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাকে ‘ঐতিহ্য প্রাঙ্গণ’ হিসেবে গড়ে তুলব। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করে ঢাকাকে তার স্বীয় গৌরবে সাজিয়ে তুলে ধরব বিশ্ব দরবারে।’

সুন্দর ঢাকা
শেখ ফজলে নূর বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা—দুই নদীর অববাহিকায় পত্তন হওয়া আমাদের এই ঢাকা। এমন শহর পৃথিবীতে বিরল! “সুন্দর ঢাকা” গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক উদ্যান নির্মাণ, সবুজায়ন, ছাদবাগানে উৎসাহ, পরিবেশবান্ধব স্থাপনা বৃদ্ধি, বায়ু ও শব্দদূষণ রোধসহ শরীর ও চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ, শরীরচর্চা কেন্দ্র এবং নারী-শিশু ও প্রবীণদের জন্য হাঁটার উন্মুক্ত স্থান, আধুনিক মানের কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থা করা হবে। সাধারণ ও ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ব্যবস্থা, দুস্থ-অসহায়দের কল্যাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

ফজলে নূর বলেন, ‘খালগুলোর অবৈধ দখল উচ্ছেদ-খনন ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় সংখ্যক নর্দমা নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও জলাধার সংরক্ষণ এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দৈনন্দিন ভিত্তিতে সড়কের ওপর থেকে আবর্জনার স্তূপ অপসারণ করা হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পাড় ঘিরে বনায়ন, বিনোদনকেন্দ্র স্থাপনসহ ব্যাপক সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যমে সুন্দর ঢাকা গড়ে তুলব।’

শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। ছবি: আবদুস সালাম
শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। ছবি: আবদুস সালাম

সচল চাকা
নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকেই অচল ঢাকাকে সচল করার কথা বলে আসছেন শেখ ফজলে নূর। এ বিষয়ে ইশতেহারের রূপরেখায় তিনি বলেন, যানজটের কারণে রাস্তায় চলাচল হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো ও ফিরে আসতে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের বিড়ম্বনা অপরিসীম। গণপরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিছু রাস্তায় দ্রুতগতির যানবাহন, কিছু রাস্তায় ধীরগতির যানবাহন, আবার কিছু রাস্তায় শুধু মানুষের হাঁটার ব্যবস্থা করব।

সবার জন্য পৃথক রাস্তা করা হবে জানিয়ে ফজলে নূর বলেন, নদীর পাড় থাকবে প্রশস্ত, সেখানে হেঁটে চলা যাবে, চালানো যাবে সাইকেল, চলবে রিকশা। দ্রুতগামী যানবাহনের জন্য থাকবে আলাদা পথ, থাকবে নিরাপদ সড়কব্যবস্থা। রাস্তা পারাপারের সুব্যবস্থাসহ নগর ঘুরে দেখার ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে প্রয়োজনীয় সড়কবাতি। পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য শহরে নামানো হবে ‘হপ অন, হপ অফ’ বাস সেবা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন সেবা রয়েছে। হকারদের তথ্যভান্ডার তৈরি করে পুনর্বাসনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ফুটপাত দখলমুক্ত করা হবে।

সুশাসিত চাকা
সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি দলের এ মেয়র প্রার্থী। তাপস বলেন, ‘মাদক নির্মূল, জুয়া, কিশোর অপরাধসহ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়জনিত বিভিন্ন অপরাধ রোধসহ এলাকাভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পঞ্চায়েতব্যবস্থা কার্যকর ও সংশোধনকেন্দ্র নির্মাণ করব। বছরের ৩৬৫ দিন, সপ্তাহের ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য খোলা থাকবে। ব্যবসায়িক লাইসেন্স ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। গৃহকর (হোল্ডিং ট্যাক্স) বাড়ানো হবে না।’

দায়িত্ব গ্রহণের ৯০ দিনের মধ্যে মৌলিক সব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়ে ফজলে নূর বলেন, মশকের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস, মশকনিধনে দৈনন্দিন ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, হাসপাতাল-ডিসপেনসারি ও প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপনসহ মাতৃসদন, পরিবার পরিকল্পনা ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে ফায়ার হাইড্রেন্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পাড়া-মহল্লায় অগ্নিনির্বাপণ গাড়ি প্রবেশের কার্যকর পদক্ষেপসহ প্রয়োজনে নিজস্ব দমকল বাহিনী গঠন করা হবে।

নগরের অন্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয়ে ফজলে নূর বলেন, প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের আগেই ঢাকার উন্নয়ন ও সেবার সঙ্গে জড়িত সংস্থার কাছে তাদের বার্ষিক কাজের চাহিদাপত্র নেওয়া হবে। করপোরেশন কোনো রাস্তা নির্মাণের পর অন্তত ৩ বছরের মধ্যে অন্য কোনো সংস্থা ওই রাস্তা খনন করতে পারবে না। আইন, বিধি ও নীতিমালা কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে ঢাকার উন্নয়ন ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সিটি করপোরেশনের কাছে সমন্বিতভাবে দায়বদ্ধ করা হবে। সপ্তাহে এক দিন নগরবাসীর সঙ্গে তাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মেয়র নিজে আলোচনা করবেন। ব্যবসায়ীদের জন্য হবে ওয়ানস্টপ সেবা।

উন্নত ঢাকা
শেখ ফজলে নূর বলেন, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে নগরীর উন্নতি সাধন, ইমারত নির্মাণ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ, নগর-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের জনগণের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণসহ প্রতিটি সড়ক ও নর্দমার উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের মান নিরূপণ করে অন্তত ১০ বছরের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বিবেচনায় নিয়ে জমির যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।

ফজলে নূর আরও বলেন, জনগণকে প্রদেয় করপোরেশনের সব সেবা, যেমন: বাণিজ্য লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধন সনদ, প্রত্যয়নপত্র, গৃহকর, পৌরকর, অন্যান্য কর তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবার আওতায় আনা হবে। সব ক্ষেত্রে অনলাইন সুবিধা সম্প্রসারণ করা হবে। নগরবাসী ঘরে বসেই কর এবং নির্ধারিত ক্ষেত্রে ফি পরিশোধসংক্রান্ত সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন এবং নাগরিক সেবা ও সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ নগর অ্যাপ চালু করা হবে। সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ই-লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হবে। নগর ভবনে নিয়ন্ত্রণকক্ষ রেখে বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা ও ফ্রি ওয়াই–ফাই জোন স্থাপন করা হবে।

ইশতেহার ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল, আফজাল হোসেন প্রমুখ।