স্মৃতিতে সরস্বতী

পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে সরস্বতী দেবীর প্রতিমা
পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে সরস্বতী দেবীর প্রতিমা

শৈশবে মা-ঠাকুরমার মুখে শুনেছি বিদ্যার দেবী সরস্বতী। সরস্বতী খুশি হলে পরীক্ষায় ভালো করা যাবে, বিদ্যা-বুদ্ধি হবে—আরও কত কী! তাই প্রতি রাতে পড়ালেখা শেষ হলে ঠাকুরমার মুখে-মুখে আমাকে কাটতে হতো এই ছড়া: ‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে/ বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে/ ত্বং সরস্বতী নির্মল বরণ, রত্ন বিভূষিত কুণ্ডল করণ।’ শৈশবে মনে হতো—ছড়া যখন কাটছি, পেছনে বেত হাতে দাঁড়িয়ে আছেন দেবী সরস্বতী। এই বুঝি পিঠের ওপর পড়ল বেত।

একসময় বিদ্যালয়ে গেলাম। মনে পড়ে, বেত হাতে নেওয়া সরস্বতী খানিকটা প্রসন্ন হয়েছেন। এবার আমাদের আয়োজনে তিনি আসবেন—তাঁকে দেখভালের দায়িত্ব আমাদের। প্রতিবছর মহাধুমধামে আমরা আয়োজন করতাম সরস্বতীপূজা। বলা ভালো, একসময়ের আমাদের বংশানুক্রমিক পৈতৃক বাড়িটাই প্রপিতামহ গ্রামবাসীদের দাবিতে স্কুলগৃহে রূপ দিয়েছেন। প্রপিতামহের পিতার নামেই স্কুলের নাম—নবকুমার ইনস্টিটিউশন। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই স্কুলের সরস্বতীপূজায় প্রপিতামহের বদান্যতার উপহারটা এসে পড়ত আমার ওপর। সবাই মিলেই উৎসবটা করতাম। বাদ যেত না স্কুলের কোনো শিক্ষার্থীই—তার নাম অরুণ হোক কিংবা শামসুল, কিংবা মিরা অথবা মমতাজ। তবু উত্তরাধিকার সূত্রে সবকিছু পরিচালনার ভারটা কেমন-কেমন করে যেন এসে পড়ত আমার ওপর। সেই সব দিনের কথা মনে হলেই আজ ভালো লাগে—অলক্ষ্যে কখনো কি নিশ্বাসও বেরিয়ে আসে না!

পূজা উৎসবে স্কুল থেকে সামান্যই আর্থিক সহায়তা পাওয়া যেত। অধিকাংশ অর্থই ছাত্রদের কাছ থেকে আমরা তুলতাম। পূজার সপ্তাহ তিনেক আগে থেকে শুরু হতো আমাদের ব্যস্ততা। কে কী করবে, কে কত টাকা তুলতে পারবে, কোন বাজার থেকে প্রতিমা আনা হবে, পুরোহিত কে থাকবেন—আরও কত কাজ আমাদের। এসব কাজে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. হাবীব উল্লাহ স্যারের সহায়তায় সব সময় আমরা সাহস পেয়েছি। উৎসাহিত হয়েছি স্কুলের অন্য সব শিক্ষকের সহায়তায়ও। ক্রমে এসে গেল পূজার লগ্ন। অবধারিতভাবেই পূজার পুরোহিত থাকতেন গ্রামের ব্রাহ্মণ হীরালাল চক্রবর্তী। কোন কোন উপচার লাগবে, কখন আরম্ভ হবে পূজা—এসব তথ্য তাঁর কাছ থেকে আমরা জেনে নিতাম।

স্বরূপকাঠি বাজার থেকে আমরা কিনতাম পূজার সব উপাদান। আমরা মানে—অরুণ, পটল, মানিক, শ্যামল, শিবু, ধীরেন, রতন, নিখিল—আরও কত জন! প্রসাদ হিসেবে অবশ্যই থাকবে শসাজাতীয় ফল মরমা, আখের গুড়, বাতাসা—এই সব। সব শিক্ষার্থীকে নিমন্ত্রণ করা, শিক্ষকদের পূজায় আসতে বলা—এসব কাজ আমরা যত্ন নিয়ে করতাম। আহা! প্রসাদ হিসেবে একটা ফলের নাম তো বলতে ভুলে গেলাম। কুল ছাড়া কি সরস্বতীপূজার কথা ভাবা যায়? কুলের পরিমাণটা একটু বেশিই রাখতে হতো। কারণ মা-ঠাকুরমাদের দেখানো ভয়ে সরস্বতীপূজার আগে আমাদের মুখে কুল উঠত না, তা এটা যতই রসাল হোক। কুল নাকি আমাদের মতো সরস্বতীরও প্রিয় ফল। তাই তাঁর পূজায় ওই উপচার। পূজার আগে কুল খেলে নির্ঘাত গোল্লা—পরীক্ষায় খাতা শূন্যে শূন্যে ভরে যাবে। তাই কুল নিষিদ্ধ। পূজার পরে কুল খাওয়া যাবে—তাই এত দিনের উপবাসী মনটা ভরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রসাদে থাকত কুলের আধিক্য।

পূজার আগের রাতে ১০–১২ জন আমরা স্কুলগৃহেই থাকতাম—সব কাজ গুছিয়ে নিতাম। ইতিমধ্যে এসে গেছে দেবী-প্রতিমা—বসানো হয়েছে তাঁকে নির্দিষ্ট আসনে। আলপনা এঁকে অস্থায়ী মন্দিরটি সাজিয়ে দিয়েছে ছাত্রীরা—মিরা, বীণা, কৃষ্ণা কিংবা ডলি। ওদের সঙ্গেই হয়তো থাকত মুকুল, মঞ্জরি কিংবা মমতাজ। কে কোন উৎসবে—এটাই একমাত্র সত্য। ক্রমে রাত গভীর হলো। আমাদের চোখের ঘুম পালিয়ে গেছে তেপান্তরে—এবার যাব আমরা ফুল তুলতে। বড় একটা ডালা নিয়ে আমরা রাতের আঁধারে গ্রাম ঘুরে ঘুরে ফুল সংগ্রহ করেছি। মালিকের অগোচরে ফুল তোলাটা এখন মনে হয় ছিল কি চুরি? ওসব তখন ভাবতামই না। গোটা ব্যাপারটাই ছিল আমাদের কাছে অভিযানের মতো।

পূজার দিনে প্রায় সবাই বাড়ি থেকে বই-খাতা-কলম আনত—ওসব রাখা হতো দেবীর চরণতলে। দেখা যেত, প্রায় সবাই নিয়ে এসেছে অঙ্কশাস্ত্র কিংবা ইংরেজি বই। বোঝা যায়, ওই দুই বিষয়ে সরস্বতীর কৃপা কত জরুরি। পূজার আগ পর্যন্ত অনেকেই উপবাস থাকত। কিছু না খেয়ে অঞ্জলি দিলে পরীক্ষায় ভালো করা যাবে—এমনি বিশ্বাস মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন মা-ঠাকুরমারা। দল-বেঁধে অঞ্জলি নেওয়াটা ছিল পূজার সবচেয়ে বেশি আনন্দের অনুষঙ্গ। কত যে দুষ্টুমি করেছি এই অঞ্জলি-পর্বে। অনেকের কানে থাকত খাগের কলম, কারও কপালে চন্দনের তিলক, আরও কত কী? ছাত্রীরা নতুন পোশাকে সেজেটেজে আসত—ভালোই লাগত। পরিবেশটা ভরে যেত উৎসবের আনন্দে।

ফেলে আসা সরস্বতীপূজার কথা লিখতে লিখতে মনে আসে পটলের কথা—আমাদের সব আয়োজনে যে ছিল সামনের লোক—সে হারিয়ে গেছে একাত্তরের রক্তস্রোতে। প্রসাদ-ক্রয়, কিংবা ফুল-তোলা, ঢাকি সংগ্রহ করা কিংবা পূজার শঙ্খ জোগাড় করা—সব কাজেই পটল ছিল আমাদের পরম সহায়। সেই পটল একাত্তরের মে মাসের কোনো এক অপরাহ্ণে আমাদের স্কুলের সামনের ধানখেতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে চিরবিদায় নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। প্রতিবছর সরস্বতীপূজা এলেই আমার মনে পড়ে পটলের কথা—কখনো বাড়িতে গেলে স্কুলের সামনে ধানখেতের দিকে তাকালে মনে হয় ধানের মাথারা হারিয়ে যাওয়া সেই পটল হয়ে আমাদের বলছে—‘সরস্বতীপূজার আর কত দিন বাকি রে?’

ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ: রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য