পাবনায় প্রবাসী পাত্র পেলেই বাল্যবিবাহ

মেয়ের নিরাপত্তার জন্য দ্রুত বিয়ে দেওয়াকেই সমাধান মনে করেন অভিভাবকেরা। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী–অধ্যুষিত জেলা পাবনায় পাত্র হিসেবে তাঁদের প্রথম পছন্দ প্রবাসীরা।

এক বছরে শুধু পাবনা উপজেলা সদরেই বন্ধ হয়েছে ৩৫০টি বাল্যবিবাহ। জেলা প্রশাসন বলছে, এর মধ্যে ৫০ শতাংশ কিশোরীর জন্য পাত্র হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল বিদেশ–ফেরত ও বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের। জেলা প্রশাসনের দেওয়া বাল্যবিবাহ–সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বন্ধ হওয়া বাল্যবিবাহের মধ্যে ভুক্তভোগী কিংবা তার পক্ষ থেকে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানোর নম্বর ৩৩৩-এ ফোন করে সহায়তা চাইলে ১০৮টি বিয়ে বন্ধ হয়। এ ছাড়া ৯৯৯ নম্বরে কল করলে ১০১টি বিয়ে বন্ধ করা হয়। এসব বিয়ের সঙ্গে জড়িত থাকায় ২৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অভিভাবকদের কাছ থেকে ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। জেলার অন্য উপজেলাগুলোতেও গত এক বছরে বন্ধ হয়েছে প্রায় ২০০টি বাল্যবিবাহ।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলছেন, যতগুলো বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়েছে, এর ৫০ শতাংশ পাত্রই ছিলেন প্রবাসী। এ ধরনের পাত্রের মধ্যে কিশোরীকে বিয়ে করার প্রবণতা আছে। অন্যদিকে মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো দুশ্চিন্তায় থাকে। অল্প বয়সে মেয়েরা প্রেমে পড়ে যায় এবং বখাটেপনার শিকার হয়। প্রবাসীরা অল্প সময় বেশ ভালো টাকার মালিক হন। ফলে অভিভাবকেরা এমন পাত্র পেলেই তাঁকে যোগ্য মনে করে মেয়েকে বিয়ে দিতে চান।

এক বছর আগে মতের বিরুদ্ধে বিয়ে ঠিক করা হয় পাবনা সদরের এক কিশোরীর। এতে অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়েটিমানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। প্রথম দিকে আত্মহত্যার কথা ভাবলেও একপর্যায়ে ৩৩৩ নম্বরে কল করে সে। বন্ধ হয় বিয়ে। একইভাবে বন্ধ হয় সদর উপজেলার ষষ্ঠ শ্রেণিরএকটি মেয়েরবিয়ে। দুটি বিয়ে বন্ধেই ভুক্তভোগীদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গ্রামের সচেতন তরুণেরা। তাঁরাই স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানান।

দুটি ঘটনাতেই কিশোরীদের পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য ছিল, খুন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ নানা সামাজিক অস্থিরতায় কন্যাসন্তান নিয়ে তাঁরা দুশ্চিন্তায় থাকেন। এ অবস্থায় বাল্যবিবাহের কুফল ও আইন জেনেও মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক বলছে, বাড়ির বাইরে যৌন হয়রানির পাশাপাশি ঘরেও কিশোরীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে থাকতে হচ্ছে অভিভাবকদের। জেলা সদরসহ জেলার ৯ উপজেলায় বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করছে ব্র্যাক। স্কুল পর্যায়ে বয়স লেখা লাল কার্ড সরবরাহ, সচেতনতা সৃষ্টি ও গ্রামভিত্তিক ‘পল্লিসমাজ’ নামে ৩০০টি নারী সংগঠন নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি।

সংস্থাটির সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির জেলা জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক লুইস গোমেজ জানান, সম্প্রতি অভিভাবক পর্যায়ের প্রায় ৬০০ নারীকে নিয়ে তাঁরা একটি সেমিনার করেছেন। এসব নারীর ভাষ্যে বিভিন্ন অপ্রীতিকর তথ্য উঠে এসেছে। মেয়েরা নিকট আত্মীয়স্বজনের কাছেও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় পরিবার প্রধানেরা মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দিতে চাইছেন।

তবে লুইস গোমেজ জানালেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জেলায় বাল্যবিবাহের হার কমেছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা এখন ভুয়া জন্মসনদ দিচ্ছেন না। এমনভাবে সামাজিক সচেতনতা আরও বাড়ানো হলে বাল্যবিবাহের হার শূন্যে নেমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।

জেলা সদরের লোহাগারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসনে আরা পারভিন বলেন, স্কুলে শিক্ষার্থীদের বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বলা হচ্ছে। মেয়েরা এখন আর বিয়ে করতে চায় না। তবে দারিদ্র্যের কারণে অভিভাবকেরা চান। তাঁদের সচেতন করা সবচেয়ে বেশি জরুরি।