ভৈরবে মাদকবিরোধী ব্যাপক অভিযান, সাফল্য সামান্য
গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটা। ভৈরব উপজেলা প্রশাসন চত্বরে ২০টি গাড়ি প্রস্তুত। প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরের ১৭৫ জন সদস্যও। উদ্দেশ্য মাদক কারবারি ধরা। মাদকবিরোধী টাস্কফোর্সের সুবিশাল এই বহরের দিনভর অভিযানে ধরা পড়েন নয়জন। জব্দ হয় ২ কেজি ১০০ গ্রাম গাঁজা ও ১০টি ইয়াবা বড়ি।
এর আগে ২১ জানুয়ারি টাস্কফোর্সের আরও একটি অভিযান চলে। সেই অভিযানের সাফল্য ৫ কেজি ৫০০ গ্রাম গাঁজা ও ১০টি ইয়াবা বড়ি জব্দ। ধরা পড়েন ১১ জন। বিপরীতে ক্ষতিটা হয়ে যায় বড়। কারণ ওই রাতেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভৈরব সার্কেল কার্যালয় আগুনে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে পুড়ে যায় ২৯ বছর ধরে করা সব মামলার নথি।
টাস্কফোর্সের অভিযান সুবিশাল ও বড় হলেও সাফল্য কম আসায় এ নিয়ে খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ভৈরব উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিমাদ্রী খীসা দুটি অভিযানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন। সাফল্য কম আসার ব্যাপারে হিমাদ্রীর ভাষ্য, ভৈরব ছোট উপজেলা। ঘটা করে একদিকে অভিযান চালালে, অন্যদিকে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে মাদক কারবারিরা সতর্ক হয়ে যায়। তাঁর ধারণা, এই কারণে সাফল্য আসছে না। এ ক্ষেত্রে রণকৌশল বদলে দেখা যেতে পারে।
রেল, নৌ ও সড়কপথের অনুকূল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অনেক আগে থেকে ভৈরব মাদকের জন্য স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখনো ভারতীয় সীমান্ত এলাকা দিয়ে আসা মাদকের চালানগুলো ভৈরবকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পাঠানো হচ্ছে। মাদকের জন্য স্পর্শকাতর অঞ্চল ভেবে ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ভৈরব সার্কেল কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। কার্যালয়টির বর্তমান অবস্থান পৌর শহরের আমলাপাড়ায়। জেলার ভৈরব, কুলিয়ারচর, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর, কটিয়াদী ও নিকলী উপজেলা এই সার্কেলের অধিভুক্ত।
সম্প্রতি ভৈরবে মাদক ও ছিনতাইয়ের আগ্রাসন বেড়েছে। মূলত মাদকের টাকা সংগ্রহ করার জন্য কিশোর-তরুণদের একটি অংশ ছিনতাইয়ে নামছে। এই বাস্তবতায় অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ভৈরবে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি অভিযানে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, ঢাকা ও ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের যুক্ত করা হচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত হন পুলিশ, র্যাব ও উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি কিশোরগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। দুটি অভিযানই পরিচালনা করা হয় পঞ্চবটি পুকুরপাড়, বাসস্ট্যান্ড, কমলপুর ও শ্রীনগর এলাকায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভৈরবে হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। মাদক সেবন করতে প্রতিদিন বাইরের এলাকার অসংখ্য মানুষ এখানে আসেন। সহজলভ্য মাদকের এত বড় অঞ্চলে অভিযান চালিয়েও সফলতা না আসায় এখন সর্বত্র নানা কথা হচ্ছে। বিশেষ করে মনে করা হচ্ছে, অভিযানে অংশ নেওয়া লোকজনের মধ্য থেকে কেউ কেউ চিহ্নিত মাদক কারবারিদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। এতে করে তাঁরা সতর্ক হয়ে যাচ্ছেন। তা না হলে বড় বড় কারবারিদের বাড়িতে গিয়েও কাউকে না পাওয়া এমনকি আলামত না থাকাটা সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ভৈরব সার্কেলের পরিদর্শক মাসুদুর রহমান বেশ বিব্রত। তিনি বলেন, ‘ভৈরবে অসংখ্য মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। প্রথম অভিযানের পর তাঁরা আমাদের কার্যালয় পুড়িয়ে দিয়ে হুমকি দিয়ে রাখলেন। আমরাও বসে নেই। পাল্টা হুমকি দিতেই অভিযান অব্যাহত আছে, থাকবে। অভিযানের দৃশ্যমান সফলতা না আসায় ভালো লাগছে না। কেন আসছে না, তার কারণও খুঁজতে হবে। তবে দৃশ্যমান সফলতা না এলেও মাদক কারবারিরা কিন্তু স্বস্তিতে নেই।’
মঙ্গলবারের অভিযানে আটক নয়জনের মধ্যে আটজনকে কারা ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুবনা ফারজানা। অভিযানে তিনিও ছিলেন। বড় অভিযানে ছোট সফলতার বিষয়ে তাঁর মন্তব্য হলো, ঘটা করে অভিযানে গেলে সফলতার মুখ দেখার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে এ ধরনের অভিযানের সুবিধা হলো, তোমাদের ছাড়ছি না—মাদক কারিবারিদের কাছে এমন বার্তা পৌঁছে যাওয়া।
টাস্কফোর্সের দুদিনের অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের কারোর আন্তরিকতার অভাব নেই। তারপরও বড় সাফল্য পাইনি। আমার ধারণা, মাদক কারবারিরা কোনো না কোনোভাবে আগেই খবর পেয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সার্কেল কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার পর চক্রটি সতর্কভাবে চলছে। তবে মাদক কারবারিরা যেন আর স্বস্তিতে না থাকতে পারে, নানা উদ্যোগ নিয়ে সেটাই করব।’