চট্টগ্রাম সিটি: কাঁধে ৪০৭ কোটি টাকার দেনা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন দেনার দায় থেকে বের হতে পারছে না। বরং অর্থসংকট প্রকট হয়েছে। অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের বিলসহ বিভিন্ন খাতে বকেয়ার পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকার বেশি। খুব শিগগির এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না।

সক্ষমতা যাচাই না করে বিভিন্ন খাতে খরচ করা, আয়ের তুলনায় উন্নয়নকাজের জন্য বেশি কার্যাদেশ দেওয়া, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা বিরাজ করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে প্রথম নির্বাচিত মেয়র হিসেবে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার সময় সিটি করপোরেশনের দেনা ছিল ২৫ কোটি টাকা। তিনি ২০১০ সালে ১৫০ কোটি টাকার দেনা রেখে বিদায় নেন। এরপর সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম ২০১৫ সালের মার্চে দায়িত্ব ছাড়ার সময় করপোরেশনের বকেয়া ছিল ১১৭ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৭ কোটি টাকায়।

বিভিন্ন উন্নয়নকাজের বিপরীতে ঠিকাদারদের প্রায় ৩০৫ কোটি টাকা বিল বকেয়া আছে। এর মধ্যে ২২০ কোটি টাকা বকেয়া হয়েছে বর্তমান মেয়রের সময়। অবসরে যাওয়া ২৮৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর আনুতোষিক পাওনা রয়েছে ৪০ কোটি টাকা। ভবিষ্য–তহবিলের সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা জমা করেনি করপোরেশন। আর বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় ২০১৭ সালে একবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় পিডিবি।

পাওনা টাকার জন্য সিটি করপোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারেরা প্রতিনিয়ত মেয়র ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দপ্তরে ধরনা দেন। কিন্তু প্রত্যাশিত অর্থ না পাওয়ায় তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও বিভিন্ন সভা-অনুষ্ঠানে আর্থিক সংকটের কারণে টাকা পরিশোধ করতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেতন-ভাতা খাতে খরচ হয় বার্ষিক ২০০ কোটি টাকা। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। আবার জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন উন্নয়নকাজও করতে হয়। এসব কারণে প্রতিবছরই ব্যয় বেড়ে চলেছে।

এই সংকট রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন মেয়র নাছির। তিনি বলেন, করপোরেশনের আয়ের অন্যতম বড় উৎস হচ্ছে গৃহকর। অপরাজনীতির কারণে নিয়ম থাকলেও তা পুনর্মূল্যায়ন করা যায় না। ফলে আয় বাড়ানো যাচ্ছে না।

সিটি করপোরেশন চলতি অর্থবছরে গৃহকর খাতে ৩৪৬ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৬ শতাংশ।

নিয়মিত জমা হয় না ভবিষ্য–তহবিলে

করপোরেশনের ভবিষ্য–তহবিল খাতে প্রতি মাসে জমা হওয়ার কথা অন্তত ১ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে মূল বেতনের ১০ শতাংশ করে ৬০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়। এর বিপরীতে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে জমা দেওয়ার কথা ৬০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

করপোরেশনের একটি সূত্র জানায়, কর্মীদের কাছ থেকে টাকা কেটে নিলেও নিজের অর্থ জমা দিচ্ছে না সিটি করপোরেশন। ২০১৭ সালের মে মাসের পর থেকে দীর্ঘদিন এই খাতে টাকা জমা হয়নি। অবশ্য চলতি মাসে আড়াই কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। তারপরও এই খাতে দেনার পরিমাণ ৩৮ কোটি টাকা।

ভুগতে হবে ‘ম্যাচিং ফান্ড’ নিয়ে

উন্নয়ন প্রকল্পের মোট ব্যয়ের একটি অংশ সিটি করপোরেশনকে দিতে হবে, যা ‘ম্যাচিং ফান্ড’ নামে পরিচিত। প্রতিটি প্রকল্পে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে ঠিকাদারদের পরিশোধ করতে হবে। বর্তমানে ছয়টি প্রকল্পের ম্যাচিং ফান্ড খাতে করপোরেশনকে দিতে হবে ৭১৭ কোটি টাকা।

সিটি করপোরেশনের বর্তমান আর্থিক অবস্থায় তা পরিশোধ করা অসম্ভব বলে মনে করছেন হিসাব ও প্রকৌশল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, প্রকল্পগুলো শেষ হলে এই টাকা পরিশোধে আরেক বিড়ম্বনা শুরু হবে। ম্যাচিং ফান্ডের টাকা যাতে দিতে না হয়, সে জন্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছেন বলে জানান মেয়র আ জ ম নাছির।

আনুতোষিকের পাওনা আদায় কঠিন কাজ

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, অবসরে যাওয়ার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৮০ মাসের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়। ২৮৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী এই খাতে পাবেন ৪০ কোটি টাকা। এই টাকা পেতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাঁদের। কেননা, এই খাতে কোনো অর্থ জমা রাখে না করপোরেশন। অন্যান্য খাতের আয় থেকে অল্প পরিমাণ টাকা পরিশোধ করা হয়।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যতম বড় অবলম্বন এই আনুতোষিকের টাকা। অনেকের পরিকল্পনা থাকে এই টাকা দিয়ে ঘর করবেন। কেউ ছেলেমেয়ের বিয়ে দেবেন। কেউ চিকিৎসা করাবেন।

অবসরপ্রাপ্ত এক চিকিৎসক ও এক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, মাঝেমধ্যে এক-দুই লাখ টাকা দেয়। অনেক সময় পারিবারিক প্রয়োজনেও পাওনা টাকা পান না।

সিটি করপোরেশনের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি করপোরেশনে যোগ দেওয়ার পর থেকে কখনো আনুতোষিক খাতে টাকা জমা রাখতে দেখেননি। তারপরও বিভিন্ন খাত থেকে টাকা এনে দেওয়া হচ্ছে।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভবিষ্য–তহবিল ও আনুতোষিকের টাকা অন্য খাতে খরচ করার সুযোগ নেই, বরং নিয়মিত জমা রাখতে হবে। গৃহকর আদায় ও নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। কেননা, সরকার উন্নয়নকাজে ভর্তুকি দেবে। ভবিষ্য–তহবিল ও আনুতোষিকের জন্য তো দেবে না।