সেরা স্কুলে সমস্যা ছাড়া কিছুই নেই

বিদ্যালয় ভবনের সিঁড়ির রেলিংয়ের আস্তরণ খসে পড়ে বেরিয়ে এসেছে রড। গত বুধবার নগরের ফিরিঙ্গিবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।  জুয়েল শীল
বিদ্যালয় ভবনের সিঁড়ির রেলিংয়ের আস্তরণ খসে পড়ে বেরিয়ে এসেছে রড। গত বুধবার নগরের ফিরিঙ্গিবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জুয়েল শীল

রঙের প্রলেপের কারণে বোঝার উপায় নেই দেয়ালের ভেতরের হাহাকারের চিত্র। কিন্তু টোকা দিলেই তা স্পষ্ট হয়—কেঁপে উঠে। রেলিং ধরে হাঁটা নিরাপদের চেয়ে বরং অনিরাপদই বেশি। কারণ সেটি ভেঙে লোহা বেরিয়ে এসেছে। শৌচাগারের অবস্থা আরও খারাপ। শ্রেণিকক্ষে বসতে হয় গিজগিজ করে।

চট্টগ্রাম নগরের ফিরিঙ্গিবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমস্যা ছাড়া যেন কিছুই নেই। অথচ ২০১৯ সালে কোতোয়ালি থানায় সেরা বিদ্যালয় এটি। এর বাইরে সহশিক্ষা কার্যক্রমেও এগিয়ে আছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বিদ্যালয় ভবনটি পুনর্নির্মাণসহ ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের জন্য ২০০৪ সাল থেকেই প্রতি তিন মাস অন্তর নানা দপ্তরে চিঠি দিয়ে আসছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু মাটি পরীক্ষা আর বিদ্যালয় পরিদর্শনেই সীমাবদ্ধ থেকেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর (এলজিইডি)। কোনো জোরদার উদ্যোগ নেয়নি। এখন দ্রুত ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হোক—এটিই একমাত্র দাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

কোতোয়ালি থানা মোড় থেকে একটু দক্ষিণে এগোলে হাতের ডান পাশে এই বিদ্যালয়ের অবস্থান। ১৯২৫ সালে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। তখন এটি ছিল বেড়ার ঘর। ১৯৭৩ সালে সরকারিকরণ হওয়ার দুই বছর পর বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। এর ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালে এসে ভবনটি উন্নীত করা হয় তিনতলায়। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় এই বিদ্যালয় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে শুরু করে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে বিদ্যালয় গিয়ে দুরবস্থার নানা চিত্র দেখা যায়। ওপরে ওঠার রেলিংয়ের ইট-সিমেন্ট ঝরে লোহা বেরিয়ে এসেছে। দুটি শৌচাগার ভাগাভাগি করে ব্যবহার করেন ৭ শিক্ষক ও ৪৮৬ শিক্ষার্থী। কিন্তু এর একটির নিচে দেয়াল আর ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ছয়টি শ্রেণি কার্যক্রম চলমান থাকলেও—শ্রেণিকক্ষ আছে সব মিলিয়ে চারটি। এসব শ্রেণিকক্ষগুলোও ৪০ জনের জন্য বরাদ্দ হলেও ঠ্যাসাঠেসি করে বসেছে ৮০ জনের ওপরে শিক্ষার্থী। প্রাকপ্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য কার্পেট বিছিয়ে পড়াশোনা করানোর নিয়ম থাকলেও শ্রেণিকক্ষ সংকটের জন্য তা করা যাচ্ছে না। কারণ, তাদের ক্লাস শেষ হতেই সেখানে তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়। ছোট্ট কক্ষে বসেন শিক্ষকেরা।

দুতলা থেকে নামছিল মোহাম্মদ আরিয়ান, স্বপূর্ণতা রায়, রিয়াজুল নুর ফাতেমা, মরিয়ম আক্তার ও কোয়েল আইচ নামের চতুর্থ শ্রেণির পাঁচ শিক্ষার্থী। তারা প্রথম আলোকে বলে, কখন শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হতে পারব—সেই চিন্তায় থাকি। কারণ, ভবনটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই শ্রেণিকক্ষে অবস্থান করতে ভয় করে।

বিদ্যালয়ের দুর্দশার কথা জানান প্রধান শিক্ষক শুক্লা মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়পড়ুয়াদের বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শিক্ষকেরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন তাদের ভালোভাবে পড়াশোনা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত রাখতে। এ জন্য বিদ্যালয়ের ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী বাংলা ও ৯৬ ভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে পঠন দক্ষতা অর্জন করেছে।

থানা পর্যায়ে ২০১৯ সালে এই বিদ্যালয় শীর্ষস্থান দখল করে। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের দল গত বছর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবলে থানার মধ্যে সেরা হয়। সব দিকেই এত এত অর্জন। শুধু বিদ্যালয় ভবনটি অনেক দিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। এ জন্য খুবই আতঙ্কে থাকতে হয়। দ্রুত নতুন ভবন নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

এক বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এই বিদ্যালয় ভবনটি ভেঙে ছয়তলা ভবন নির্মাণের জন্য চিঠি দিয়ে আসছেন বলে জানান কোতোয়ালি থানা শিক্ষা অফিসার শর্মিষ্ঠা রানী মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দফায় এলজিইডির কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন। আশা করছি, খুব শিগগির বিদ্যালয় ভবনটি ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হবে।’

বিদ্যালয় ভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন এলজিইডির জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী খলিলুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যালয়ের জায়গাটি খুবই সংকীর্ণ। এরপরেও নতুন ভবন নির্মাণের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। এ জন্য রাজনৈতিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি মনে করেন তিনি।’

শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর নির্বাচনী আসনে পড়েছে এই বিদ্যালয়টি। কোনো উপায় না পেয়ে এখন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।