ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই আবার আগুন

শুলকবহরের ডেকোরেশন গলির ‘হুমায়ুন কলোনিতে’ আজ শুক্রবার আগুন লাগে। মুহূর্তেই সব হারিয়েছে শতাধিক পরিবার। গত শুক্রবারও ঠিক একই সময়ে পাশের ‘শাহনেওয়াজ বাবু কলোনিতে’ আগুনে পুড়েছিল শতাধিক ঘর। ছবি: জুয়েল শীল
শুলকবহরের ডেকোরেশন গলির ‘হুমায়ুন কলোনিতে’ আজ শুক্রবার আগুন লাগে। মুহূর্তেই সব হারিয়েছে শতাধিক পরিবার। গত শুক্রবারও ঠিক একই সময়ে পাশের ‘শাহনেওয়াজ বাবু কলোনিতে’ আগুনে পুড়েছিল শতাধিক ঘর। ছবি: জুয়েল শীল

‘এক সপ্তাহ আগে পাশের বস্তিতে আগুনে সব হারানো মানুষগুলোকে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিলাম। ১৪টি নতুন শাড়ি, গায়ের শার্ট ও টি–শার্ট পরিয়ে দিয়েছিলাম। খাবার তুলে দিয়েছিলাম অনেকের মুখে। আজ একই রকম আগুনে আমিই পথের ফকির। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জি আর পরনের লুঙ্গিটা ছাড়া কিছুই রইল না।’

বলতে বলতে চোখ ভিজে ওঠে নুর আলমের। কথা আটকে যাচ্ছিল গলায়। কিছুটা সামলে চল্লিশোর্ধ্ব এই গাড়িচালক বলে ওঠেন, ‘এটি দুর্ঘটনা নয়। এই আগুন পরিকল্পিতভাবে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড়লোকেরা নিজেদের দ্বন্দ্বের সাধ মেটাল গরিব মানুষগুলোর ওপর।’ বলতে বলতে ফের কথা হারিয়ে যায় কান্নায়।

আজ শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় নগরের শুলকবহরের ডেকোরেশন গলির ‘হুমায়ুন কলোনিতে’ আগুন লাগে। মুহূর্তেই সব হারিয়েছে শতাধিক পরিবার। গত শুক্রবারও ঠিক একই সময়ে পাশের ‘শাহনেওয়াজ বাবু কলোনিতে’ আগুনে পুড়েছিল শতাধিক ঘর। সেই ক্ষত সারিয়ে ওঠার আগেই আবার আগুন। তাই বস্তির আশপাশ থেকে চারটি শব্দই ভেসে আসছিল, ‘আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

বস্তিবাসীর এমন শঙ্কার আঁচ পাওয়া যায় পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও মালিকপক্ষের বক্তব্যেও। আগুনের ঘটনার তিন ঘণ্টা পর শাহনেওয়াজ বাবু, তাঁর ভাই সেলিম নেওয়াজ এবং তাঁদের চাচাতো ভাই মো. হুমায়ুনের বাসায় ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছেন ২০-২৫ জন যুবক।

এই বস্তিতে থাকা বেশির ভাগই নিম্নবিত্তের মানুষ। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল বলে অনেকেরই দেরিতে ঘুম ভাঙে। কেউ ব্যস্ত ছিলেন মুখ ধোয়ায়। কেউবা রান্নাবান্নায়। এমন সময় ‘আগুন’ ‘আগুন’ শব্দে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। সরু গলি বলে বের হতেই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় তাঁদের। সেখানে জিনিসপত্র নিয়ে বের হওয়ার তো প্রশ্নেই আসে না। ফলে চোখের সামনেই কষ্টে কেনা জিনিসপত্র, টাকাপয়সা পুড়তে দেখেছেন সবাই। পরে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিটের ১৪টি গাড়ি ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

পুড়ে যাওয়া ঘরের এক কোণে নির্বাক বসেছিলেন জাহানারা বেগম। কোলে ঘুমাচ্ছিল ক্লান্ত চার বছরের ছেলে আরাফাত। বের হতে গিয়ে সে মাথায় আঘাত পেয়েছে। জাহানারা বলেন, অন্যের বাসায় কাজে গিয়েছিলেন। স্বামী রফিকুল ইসলামও চলে গিয়েছিলেন রিকশা চালাতে। বাসায় ছিল দুই ছেলে। কষ্ট করে কেনা জিনিসপত্র আজ কিছুই নেই। কোথায় থাকবেন, তাও জানা নেই।

ধ্বংসস্তূপে তন্ন তন্ন করে ঘাঁটছিলেন রহমত আলী। চকবাজারের একটি ডিশ সংযোগের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতিষ্ঠানের দরজার চাবি ছিল তাঁর কাছে। সেটিই খুঁজতে খুঁজতে রহমত বলেন, ‘শুক্রবার বন্ধ ছিল বলে ঘুমাচ্ছিলাম। আগুন আগুন শব্দে ঘুম ভাঙে। কোনোমতে দৌড়ে বের হয়ে জীবন বাঁচিয়েছি।’ তিনিও বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে হয়তো। না হয় একই সময়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে একই জায়গায় আগুন লাগবে কেন?’

আগুনে মুহূর্তেই সব হারিয়েছে শতাধিক পরিবার। ছবি: জুয়েল শীল
আগুনে মুহূর্তেই সব হারিয়েছে শতাধিক পরিবার। ছবি: জুয়েল শীল

পরিকল্পিত আগুনের অভিযোগ
প্রায় দুই একর জায়গার ওপর হুমায়ুন ও বাবু কলোনি। হুমায়ুন ও বাবু সম্পর্কে চাচাতো ভাই। জায়গাটি হুমায়ুন ও বাবুদের দাদারা ওয়াক্ফ করে গেছেন। এরপর থেকে তাঁদের স্বজনেরা সেখানে ঘর তুলে ভাড়া দিচ্ছেন।

শাহনেওয়াজ বাবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাদার আমল থেকে এই জায়গা আমরা স্বজনেরা ভোগ করছি। এর মধ্যেই আমাদের কিছু আত্মীয় জায়গা রেজিস্ট্রি করে নেয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিও। কিন্তু ওয়াক্ফ জায়গা তো রেজিস্ট্রি করা যায় না। আমাদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে তারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। পরে আমরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছি গুজব ছড়িয়ে বাড়ি আর গাড়ি ভাঙচুর করেছে।’

তবে অন্য পক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পুলিশের কোনো সদস্যও নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। সন্দেহভাজন তিনজনকে ধরে পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহনেওয়াজ বাবুর দাবি সঠিক হতে পারে। আবার যারা দখল করে আছে, তাদের উচ্ছেদে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। সবকিছু বিবেচনা করে তদন্ত করা হচ্ছে।’

এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক আজিজুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একই জায়গায় বারবার আগুন কেন, তা তদন্ত করে বলতে হবে।’

আগুনের ঘটনাটিকে রহস্যজনক উল্লেখ করে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন শুলকবহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোরশেদ আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেখানে বসবাসকারীরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০০ পরিবার পথে নামল। এই জায়গা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মামলা আছে। তাই এটি পরিকল্পিত কি না, সেটি বের করা হোক।’