অনিশ্চয়তার দিনলিপি

চীনের সব কটি প্রদেশের মানুষই সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করছে
চীনের সব কটি প্রদেশের মানুষই সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করছে
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। রহস্যময় এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। এখন এই শহর তো বটেই, পুরো হুবেই প্রদেশকে আলাদা করা হয়েছে চীনের অন্য অঞ্চল থেকে। তাঁদেরই চারজন লিখেছেন আতঙ্কিত ও অবরুদ্ধ সময়ের কথা।

ভীতিকর দিন কাটাচ্ছি
যখন লিখতে বসেছি, বর্ষপঞ্জির পাতায় দিনটি—২৮ জানুয়ারি। এরই মধ্যে সাত দিন কেটে গেছে, আমরা স্রেফ গৃহবন্দী। প্রতিটি সকাল শুরু হয় আতঙ্ক দিয়ে। খবরে দেখি, ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে চীনসহ বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। এখন যেন নিশ্বাস নিতেও ভয় হয়। এই বুঝি আক্রান্ত হলাম—এমন আতঙ্ক মনে। জীবনে সবচেয়ে ভীতিকর দিনগুলো কাটাচ্ছি যেন। এমন অনিশ্চিত দিনের মুখোমুখি আগে তো কখনো হইনি!

অথচ সপ্তাহখানেক আগেও আমার সকাল শুরু হতো গবেষণার কাজে মনোযোগী হয়ে। তারও আগে ঘুম থেকে উঠে ব্যস্ত হতাম আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে। নিজেদের নিয়ে আরও কতশত ব্যস্ততায় ভরা থাকত প্রতিটি দিন।

হঠাৎ করেই যেন সব ব্যস্ততা থমকে দাঁড়াল। এই উহান শহরেই করোনাভাইরাসের উৎপত্তি, বিস্তার। তাই এমনই আতঙ্ক যে মেয়েকে পাশের খেলার মাঠেও নিয়ে যেতে পারছি না। প্রতিবেশী কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। আমার ছোট মেয়েটা কার্টুন তেমন পছন্দ করে না, তারপরও সময় কাটাতে দিচ্ছি। দিনে দিনে সেও যেন ক্লান্ত।

ইসরাত জাহান
ইসরাত জাহান

চীনের এই উহান শহরের সঙ্গে আমার সাড়ে তিন বছরের জানাশোনা। স্নিগ্ধ এই শহরে আমাদের কতশত সুন্দর মুহূর্ত। মানুষেরা প্রাণবন্ত। সেই শহরই আজ যেন এক মানবশূন্য মৃত্যুপুরী। শহরের মধ্যে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ। উহানের বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না, কারও আসারও উপায় নেই। এই সময়টায় চীনা নতুন বছর উদ্‌যাপনের ছুটি থাকে। বছরজুড়ে অপেক্ষা উৎসবের। মানুষের কত প্রস্তুতিই না ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলে কত পরিকল্পনাই না করেছিলাম। যার মধ্যে ছিল কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথাও। কিন্তু কিছুই হলো না। ছড়াল ভাইরাস। ভাইরাসের ভয়ে উৎসব বাতিল করা হলো। মানুষজনের মনে ভয়, ঘরের বাইরে মানুষের কদাচিৎ যাতায়াত।

তবে এই সংকটের মধ্যেও খবরে দেখছি চীনাদের দেশপ্রেম। তাদের দেশের প্রতি দরদ চোখে পড়ার মতো। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা তাদের রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য। চিকিৎসক জানেন, রোগীর মাধ্যমে তিনিও ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবু চিকিৎসা দিচ্ছেন নিবিড়ভাবে। বারবার সবাইকে গরম পানি খাওয়া, মাস্ক ব্যবহার করা, হাত ধোয়া আর কক্ষ গরম করতে বলছে।

এদিকে খবরে জেনেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন, উদ্যোগও শুরু হয়েছে। এই খবরে যেন এখানকার প্রায় ৩০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আশা করি দ্রুত দেশে ফিরতে পারব। সেই সঙ্গে প্রার্থনা করি, নিরাপদ হোক চীন। নিরাপদ থাকুক সারা বিশ্বের মানুষ।

লেখক: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্সে পিএইচডি গবেষক, উহান।

টুম্পা প্রমানিক প্রত্যাশা করছেন ক্যাম্পাসে এমন উচ্ছ্বাসের দিন দ্রুতই ফিরে পাবেন
টুম্পা প্রমানিক প্রত্যাশা করছেন ক্যাম্পাসে এমন উচ্ছ্বাসের দিন দ্রুতই ফিরে পাবেন

এটা তো কারাবাসই
টুম্পা প্রামানিক
রোজ সকালে ঘুম ভাঙলে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দাটা সরাতাম। স্নিগ্ধ সকাল দেখতাম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে। কিছুদিন ধরে তা আর করা হয় না। জানালাটা খুলব খুলব করেও খুলি না—ভয়ে আর আতঙ্কে। হুট করে মনে হয়, এই বুঝি বাতাসে ভেসে এল করোনাভাইরাস।

এই আতঙ্ক আমার মতো এই জিংমেন শহরের সবার মনেই। পাশের শহর উহানেই উৎপত্তি করোনাভাইরাসের, তাই আতঙ্ক যেন আরও বেশি। আগে যেমন বাইরে তাকাতেই দেখতাম, রাস্তায় অনেক গাড়ি, বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ যাত্রী, খাবারের দোকানসহ বিভিন্ন দোকানে মানুষের ভিড়। কদিন হলো তার কিছুই নেই। দোকানপাট কার্যত বন্ধ। ব্যক্তিগত গাড়িও দেখি না। পথ আর ভবনগুলো যেন নীরব দাঁড়িয়ে আছে জনমানবহীনতার সাক্ষী হয়ে। আমাদের ক্যাম্পাস এলাকায় শ্মশানের আবহ যেন। তাই তো আমার ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালেই মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে। মনে উঁকি দেয়, আজই হয়তো শেষ দিন; হয় জীবনের, নয় এই ‘কারাবাসের’।

এটা কারাবাস নয়তো কী! আমাদের পুরো হুবেই প্রদেশ বন্ধ করা হয়েছে, কোনো যানবাহন শহর থেকে কোথাও যাচ্ছে না বা আসছে না। বলা যায় আমরা গৃহবন্দী হয়ে আছি। ঘরে বসেই অনেকের মতো আমরাও খবরে জানছি, করোনাভাইরাস ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আতঙ্কও।

আমরা জেনেছি, ভাইরাসটি বাতাসে ছড়ায়। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রতিষেধকও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই সতর্ক থাকা একমাত্র উপায়। তারপরও যদি বাইরে যেতে হয়, তাহলে যথেষ্ট সাবধানতা নিয়েই যাচ্ছে মানুষ।

বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, মাংস বা সামুদ্রিক খাবার থেকে উৎপত্তি এই ভাইরাসের, তাই আমরা এসব খাবারও এড়িয়ে চলছি। শাকসবজি খেয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছি। কিন্তু তা আর কত দিন? কিছু খাবার ঘরে আনা ছিল, তা দিয়েই চলছে। আরও কিছুদিন এমন গৃহবন্দী থাকতে হলে সরবরাহের জন্য খাদ্যসংকট তৈরি হবে।

টুম্পা প্রামানিক
টুম্পা প্রামানিক

চীনা নববর্ষের কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি চলছে। এমন সময়ে আমার দৈনন্দিন আড্ডার সঙ্গে ঘোরাঘুরিরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ঘোরাঘুরি তো দূরের কথা, আমরা ঠিকমতো আড্ডাও দিতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একজনকে অন্যজনের কক্ষে যেতেও নিষেধ করেছে।

আমরা এখানে আটজন বাঙালি ছাত্রী একই ডর্মে থাকি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মনোবল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহায়তা করছে। প্রতিদিন নানাভাবে আমাদের খেয়াল রাখছে। ছুটির মধ্যেও কিছু কর্মরত ব্যক্তি কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। আমাদের ঘরসহ পুরো ডরমিটরিতে প্রতিদিন রোগজীবাণুনাশক দেওয়া হচ্ছে। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাট বা ফোনের মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। বিভিন্ন গ্রুপে পুরো চীনের হালখবর পাচ্ছি মিনিটে মিনিটে। সেসব খবরের সঙ্গে অনেক গুজবও ভেসে আসছে।

অথচ এই সময়টা চীনবাসীদের আনন্দ করার কথা। কথা ছিল আনন্দের আলো জ্বালানোর। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে খাওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার, আনন্দ করার। কিন্তু এখন সেই মানুষেরা জীবন নিয়ে শঙ্কিত। 

তবে আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাস ধরে রেখেছি। এমন দুঃসময়ের মোকাবিলা করতে আমরা পারব। কিছুদিনের মধ্যে হয়তো আতঙ্কের আঁধার কেটে যাবে। আবার ফিরব ক্যাম্পাসে। অপেক্ষা করব ছুটির। তখন সুস্থভাবে ফিরব দেশে, মায়ের কাছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জিংচু ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, জিংমেন, চীন।

কয়েক দিন আগেও ক্যাম্পাসে এমন আড্ডাময় সময় কাটত শাফায়েত উল্লাহদের
কয়েক দিন আগেও ক্যাম্পাসে এমন আড্ডাময় সময় কাটত শাফায়েত উল্লাহদের

কত দিন আকাশ দেখি না
শাফায়েত উল্লাহ খান
অনেকের মতো আমারও ইচ্ছে ছিল শীতের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাবার। টিকিটও কেটে রেখেছিলাম। কিন্তু যাওয়ার আগের দিনই খবরটা জোরালো হলো, বন্ধ করে দেওয়া হলো পুরো শহরের সবকিছু। দেখতে দেখতে বন্ধ হয়ে গেল সব ধরনের যাতায়াতব্যবস্থা। ঝাঁপ নামল কাঁচাবাজারের দোকান থেকে সুপারশপ, খাবারের দোকানেও। এখন উহান যেন জনমানবহীন ভুতুড়ে এক শহর। আমাদের সার্বক্ষণিক ঘরেই থাকতে হচ্ছে। সপ্তাহখানেক ধরে নিজের ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারছি না। কারাবন্দীরা যেমন খোলা আকাশ দেখতে পারেন না, আমারও ঠিক তেমন অবস্থা। হুট করেই মনে হয়, কত দিন আকাশ দেখি না।

শাফায়েত উল্লাহ খান
শাফায়েত উল্লাহ খান

আমাদের গ্রীষ্মের ছুটিটা দীর্ঘ হয়। তাই শীতের ছুটিতে দেশে ফেরা হয় ন। কিন্তু এখন বারবার মনে হচ্ছে এই ছুটিতে দেশে চলে গেলেই ভালো হতো! অন্তত এমন শঙ্কায় ও আতঙ্কে নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হতো না। এদিকে আরও চিন্তা করতে হচ্ছে খাবার নিয়ে। আমাদের ঘরে আগে থেকে যা খাবার কেনা ছিল, তা–ও শেষ হয়ে আসছে। কিছুদিন পর হয়তো খাবারের সংকটে পড়তে হবে।

আমরা তো তবু একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ওদিকে আমাদের চেয়েও বেশি আতঙ্কে দিন পার করছে দেশে থাকা পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিতজন। সারা দিন সবাই ফোন, মেসেঞ্জার বা অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমে খোঁজখবর নিচ্ছেন। আমাদের নিয়ে তাঁদের চিন্তা যেন থামছেই না। তাঁদের চিন্তিত দেখে আরও বেশি খারাপ লাগছে।

স্বস্তির বিষয় হলো চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন। আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, ফিরে যেতে পারব নিজ দেশে। হয়তো দ্রুতই উহান ফিরে পাবে তার আগের রূপ ও ঐতিহ্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, হুবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, উহান, চীন।

নাইমুর রহমান
নাইমুর রহমান

কোনো অচেনা জায়গায় আটকে পড়েছি
নাইমুর রহমান
গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকের কথা। আমাদের একজন শিক্ষক ক্লাসে বলেছিলেন মাস্ক পরতে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে, যতটা পারা যায় গণপরিবহনে না চড়তে। জানিয়েছিলেন, বাজার থেকে সামুদ্রিক মাছ না কিনতে, জীবজন্তু থেকে দূরে থাকতে। তখনই করোনাভাইরাস সম্পর্কে কিছুটা জানা যাচ্ছিল। কিন্তু সেদিন স্যারের পরামর্শগুলো খুবই সাধারণ মনে হয়েছিল আমাদের কাছে। কারণ, তিনি সবশেষে এ–ও বলেছিলেন, কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

কিন্তু সেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। দিন দিন খারাপ হয়েছে। এখন তো মারাত্মক আকার ধারণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের নতুন বার্তা দিয়েছে কিছুদিন আগে, আমরা যেন রুম থেকে বিনা প্রয়োজনে বের না হই। সবাইকে তাপমাত্রা পরীক্ষা করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমরা যারা ডরমিটরি অবস্থান করছিলাম, শুরুতে আমরা বিপাকে পড়ে গেলাম। কারণ, শীতের ছুটিতে ক্যানটিন, সুপারমার্কেটগুলো বন্ধ থাকে। তাই অনেকে শুধু সপ্তাহখানেকের জন্য বাজার করে রেখেছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটা অনির্দিষ্টকালের। অনেকেই খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। তবে আশায় আছি, নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে।

আমরা উহানে এ মুহূর্তে প্রায় ৩০০ জন বাংলাদেশি অবস্থান করছি। তার মধ্যে কিছু শিশুও আছে। আমরা সবাই একটি উইচ্যাট গ্রুপে পরস্পর যোগাযোগ রাখছি। আমরা চরম উৎকণ্ঠা আর হতাশার মধ্যে দিন পার করছি। চাইলেও দেশে ফিরতে পারছি না। হতাশা আমাদের গ্রাস করছে। অনেকেই দেশে ফেরার জন্য আকুল আবেদন করছে। এমন অবস্থায় কিছু বাংলাদেশি গণমাধ্যম আমাদের নিয়ে মনগড়া খবর প্রচার করেছে। যে কারণে আমাদের পরিবার–পরিজনকে আরও হতাশায় নিমজ্জিত করছে।

এই তো এক সপ্তাহ আগেও এই উহানে বাইকে করে এখানে–সেখানে ঘুরেছি। রঙিন রঙিন বাতিতে আলোকিত ছিল যে শহর, মানুষের ভিড় ছিল মোড়ে মোড়ে কিন্তু আজ এই শহর যেন এক ভুতুড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় খাবারের খোঁজে বাইরে গেলে কোথাও কোনো দোকান খোলা পাইনি, বরং নিস্তব্ধ এক শহর পেয়েছি। রাস্তায় নেই কোনো গাড়ি, নেই কোনো মানুষ। আমার ঘর থেকে উহানের অপটিকস বেলির গ্যালাক্সি পয়েন্টের হাজার রঙের বাতি জ্বলতে দেখা যেত, আজ সবই নেভানো। যত দিন যাচ্ছে, ততই কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কোনো অচেনা জায়গায় আটকে পড়েছি।

আমার পরিবারে চারজন সদস্য। আমরা চারজন চার জায়গায় থাকি। তাদের মধ্যে আমি আর বড় ভাই চীনে। তবে  দুই শহরে। আব্বা শ্রীলঙ্কা আর আম্মা দেশেই। মাঝেমধ্যে এই ভুতুড়ে শহর দেখে মনের ভেতর অজানা এক ভয় চলে আসে। আবার চারজন একসঙ্গে দেখা করতে পারব তো!

লেখক: শিক্ষার্থী, চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্স, উহান, চীন।

উহান শহরের একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক বিশেষ কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়েছেন নিজেকে। ছবি: সংগৃহীত
উহান শহরের একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক বিশেষ কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়েছেন নিজেকে। ছবি: সংগৃহীত

তথ্যবিচিত্রা
করোনাভাইরাস
করোনাভাইরাস মূলত ভাইরাসের বড় একটি গোত্র। এই ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৬০ সালে।  করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, তার মধ্যে কয়েকটি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের যে প্রজাতির সংক্রমণ ঘটেছে, তা এর আগে দেখা যায়নি বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এই ভাইরাসের সংক্রমণে সাধারণ সর্দি–ঠান্ডা থেকে শুরু করে সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) পর্যন্ত হতে পারে। অনেকের হয়তো জানা আছে, ২০০২ সালে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল সার্স। যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল আর সংক্রমিত হয়েছিল ৮ হাজার ৯৮ জন। সেটিও ছিল একধরনের করোনাভাইরাস।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসটি মানুষ এবং পশু—উভয়ে ছড়াতে পারে। কোনো রকম স্পর্শ ছাড়াই মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় ভাইরাসটি। এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মানুষের শ্বাসকষ্ট হয়। অনেক রোগীর জ্বর ও কফ হয়। এটি মারাত্মক আকার ধারণ করলে রোগীর নিউমোনিয়া হতে পারে। হতে পারে ব্রংকাইটিসও। এ ছাড়া কিডনি অকার্যকরও হতে পারে। তরল জমতে পারে ফুসফুসে।

প্রতিষেধক যেহেতু আবিষ্কৃত হয়নি, তাই এই রোগ থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো সচেতনতা তৈরি করা। আক্রান্তব্যক্তিদের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেওয়া।

বিমান যাচ্ছে তাঁদের আনতে
করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান শহর। চীনে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, দেশটিতে প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশি আছেন। এর মধ্যে করোনাভাইরাস উপদ্রুত উহান শহরে বাংলাদেশি আছেন ৪৫০ জন। তাঁদের মধ্যে ৩১৪ জন দূতাবাসের কাছে দেশে ফেরার জন্য নিবন্ধন করেছেন। তাঁদের আনতে বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ একটি ফ্লাইট গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা। প্রথম আলোকে বিমান সূত্র বলেছে, এই ফ্লাইটের মাধ্যমে তিন শতাধিক যাত্রী দেশে ফিরতে পারেন।

৩১ জানুয়ারি দুপুরে উহান থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী শাফায়েত উল্লাহ খান বলেন, ‘চীন সময় সাড়ে ৫টায় আমাদের বাসে করে বিমানবন্দরে নেওয়ার কথা। তবে ফ্লাইট ছাড়ার সময় নিশ্চিত জানি না। সম্ভবত আজ (৩১ জানুয়ারি) রাতেই আমরা দেশে ফিরতে পারব।’

ছুটির দিনে প্রতিবেদক