'দ্যাখেন না মিডিয়া আছে, ফিতা খোলেন'

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোটারের তুলনায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর সমর্থকের সংখ্যাই বেশি দেখা গেল। তাঁরা ভোটার লাইনে দাঁড়ালেও গলায় ছিল ফিতায় আটকানো দলীয় প্রার্থীর প্রতীক ও প্রার্থীর ছবি দিয়ে বানানো কার্ড। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি দেখলেই প্রার্থীর সমর্থকেরা বেশ জোরেই বলছিলেন, ‘দ্যাখেন না মিডিয়া আছে, গলার ফিতা খোলেন...।’ তখন কার্ড ঝোলানো ভোটাররাও তড়িঘড়ি করে গলা থেকে কার্ড খুলে ব্যাগে বা হাতে রাখছিলেন।

ওয়ার্ডটির গ্রাফিক্স আর্ট ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে দুই নারী ভোটারকে গলায় কার্ড ঝুলিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেখে জানতে চাইলে একজন হেসে বলেন, ‘ভুল হইছে, খুইল্যা ফেলতাছি।’

শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওয়ার্ডটির প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। মোহাম্মদী আশরাফুল মাদ্রাসা ও এতিমখানায় সকাল আটটা পার হয়ে গেলেও কোনো ভোটারের উপস্থিতি ছিল না। তারপর একটু উপস্থিতি বাড়লেও ভোটারদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীর কর্মীরা যে ভোটার স্লিপ হাতে দিয়েছেন, তার সঙ্গে মিল ছিল না ভোটার তালিকার। ফলে ভোটারদের এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে দৌড়াতে হয়। ভোটের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা অনেক ভোটারের অনুরোধে ইভিএম মেশিনে জাতীয় পরিচয়পত্র ঢুকিয়ে দেখান যে তিনি সে কেন্দ্রের ভোটার নন।

গ্রাফিক্স আর্টস ইনস্টিটিউটের সামনে নৌকা প্রতীকের কাউন্সিলর প্রার্থীর এক নারী সমর্থককে কয়েকজন নারীর সঙ্গে রাগত স্বরে কথা বলতে শোনা গেল। তিনি নারীদের বলছিলেন, ‘আপনাদের আনা হইছে কি চেয়ারে বইস্যা থাকার জন্য।’ এক নারী আস্তে করে বলেন, ‘ভোট দেওয়া তো শ্যাষ।’ তখন ওই নারী কর্মী আবার বলেন, ‘শেষ হইছে তো কী হইছে, যান ভোটারের লাইনে গিয়া দাঁড়ান।’ কিছুক্ষণ পর প্রতিবেদক ওই লাইনের সামনে গিয়ে ভোট দেওয়ার পরও লাইনে দাঁড়িয়েছেন কেন জানতে চাইলে এক পুরুষ কর্মী ওই নারীকে প্রায় জোর করেই সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভোট দিছেন তো, আবার লাইনে দাঁড়াইছেন কেন?’ তখন ওই নারীও সরাসরি বলে দিলেন, ‘আপনারাই তো দাঁড়াইতে কইলেন।’ তখন পুরুষ কর্মী আস্তে করে চলে গেলেন অন্যদিকে।

এবারের নির্বাচনে ভোটারদের কিছু বাণিজ্যও হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভোটার বলেন, কর্মীদের দেখিয়ে দেওয়া প্রতীকে ভোট দিলে ৫০০ টাকা এবং দুপুরে বিরিয়ানির প্যাকেট দেওয়ার কথা আছে। তবে প্রকাশ্যেই ৫০০ টাকা পেয়ে এক নেতা কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, টাকাটা কম হয়ে গেল।

ভোটারদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও ছিল। তবে তা নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দেওয়ার পরই খাবার দেওয়া হচ্ছিল। কর্মীদের দেওয়া পাউরুটি খেতে খেতে এক নারী ভোটার বলেন, ‘ভোট দেওয়ার পর কে যেন রুটি দিয়া গেল, খিদা লাগছিল, তাই খাইতাছি।’

কেন্দ্রগুলোতে দলীয় কর্মী ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশে গণমাধ্যমকর্মীদের দেখলেই তৎপরতা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। বছিলা (পুরাতন) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেটের ভেতরে এক দলীয় কর্মী মোবাইল হাতে ভেতরে ঢুকতে চান। তখন কেন্দ্রের ভেতরে ছিলেন ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের ঘুড়ি প্রতীকের কাউন্সিলর প্রার্থী আসিফ আহমেদ। ওই কর্মীকে ঠেকাতে এক পুলিশ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের দিকে ইশারা করে বলেন, সব সময় একই রকম করলে চলে?

কেন্দ্রগুলো ঘুরে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের ভেতরে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টের উপস্থিতি চোখে পড়লেও অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের উপস্থিতি ছিল না। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা অবশ্য বলার চেষ্টা করেন, অন্য এজেন্টরা হয়তো বাইরে কোনো কাজে গেছেন।

ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম এবং ভোটারদের মধ্যে উৎসাহেরও কমতি ছিল। ভোট দিতে আসা ভোটারদের মধ্যে তেমন কোনো শঙ্কাও ছিল না। এক ভোটার বলেন, গন্ডগোলের আশঙ্কা নেই, প্রতিপক্ষই তো নেই, গন্ডগোলটা করবে কে।

৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আসিফ আহমেদ বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শনে ব্যস্ত ছিলেন। দুটি কেন্দ্রে প্রতিবেদকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সকালের দিকে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ভোটাররা আনন্দ ও আন্তরিকতার সঙ্গে ভোট দিচ্ছেন। ভোটার উপস্থিতি কম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ওয়ার্ডে ১৭টি কেন্দ্রে ৬৫ হাজার ভোটার। শীতের সকালে ভোটাররা ব্রেকফাস্ট করে আসতে আসতে একটু দেরি তো হবেই। শুধু দু–একটি কেন্দ্র দেখে ভোটার কম তা বলা যাবে না। এবার যেভাবে ভোট হচ্ছে তাতে কোনো গন্ডগোলের আশঙ্কা নেই বলেও জানালেন এ প্রার্থী।