ভোট নিয়ে ফেসবুকে স্বস্তি-অস্বস্তির কথা লিখেছেন পাঠকেরা

শেষ হলো ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন। দিনভর কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে প্রচুর। ভোটের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন অনেকেই। কারও কারও মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্টি দেখা গেলেও অধিকাংশ মানুষ এ নির্বাচন নিয়ে দেখিয়েছেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ভোট দিতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। আবার ভোট দিয়ে স্বস্তিও প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো ভোটার।

জহিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ভোট দিতে গেলে নিজেকে খুব অগুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। প্রথমত, শুনেছি সবার ভোট নাকি অন্যরা দিয়ে দেয়। কিন্তু আমার জন্য এই কাজটি কেউ কোনো দিন করে দেয় না। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রে গেলে কেউ কোনো দিন আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। আজও কেন্দ্রে গেলাম, কেউ একজনও সামনে এসে বলল না-অমুক মার্কায় একটা ভোট দিয়েন। বুথে ঢুকলাম, কেউ বলল না যে নৌকায় ভোট না দিলে ভোট দিতে দেব না। নম্বর বললাম, মিলিয়ে নিয়ে মেশিন দেখিয়ে দিলাম। ভোট দিলাম। চলে এলাম। ও হ্যাঁ, ভোট দিয়েছি ফজলে নূর তাপসকে নৌকায়। বাকি যে দুজনকে দিয়েছি তাদের নাম জানি না। শুধু নৌকা মার্কার রশির সঙ্গে পোস্টার দেখে মার্কা দুটো মনে রেখেছিলাম, রেডিও আর আনারস।’

আলী রীয়াজ লিখেছেন, ‘যে দেশের মানুষের কাছে নির্বাচন ছিল উৎসব, ভোট দেওয়া ছিল একই সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব-ষাট শতাংশ ভোট কোনো বিষয় ছিল না সে দেশের মানুষকে ভোটকেন্দ্র বিমুখ করতে পারার এই ঐতিহাসিক কাজ যে বা যারা সুচারুভাবে সম্পাদন করতে পেরেছেন তাদের নোবেল পুরস্কার না পারেন জাতীয় একটা পুরস্কার দিন—তাঁর বা তাঁদের এই ইতিহাস তো এক শ বছরেও ঘটেনি। আমরা যেন তাঁদের চিনি জানি-সকাল সন্ধ্যা তাঁদের নাম জপ করি সেই সুযোগ দিন। ভোটকেন্দ্রের অভিজ্ঞতার কথা যারা বলছেন তাঁদের কাছ থেকে শুনুন, কোথা দিয়ে কি হয়েছে তাঁরা টের পাননি। ইভিএম নামের যে রঙ্গমঞ্চ সাজানো হয়েছে তার হাল কি হবে তা গুগল করতে যারা পারেন তারা আগেই জানেন। সেই রঙ্গমঞ্চের কুশীলব—ভাঁড়ও বলতে পারেন, আজকে যা বলেছেন তা বাঁধিয়ে রাখুন। এখনো তো সফটওয়্যারের খেলার খবর পাননি, অপেক্ষা করুন। একে আপনারা নির্বাচন না বলে অন্য কিছু বলুন। উদ্দেশ্যটা তো দুর্বোধ্য নয়। মানুষ বলবে-“এই নির্বাচন চাই না”, আপনাদের ভাষ্যে সেটা দাঁড়াবে “জনগণ নির্বাচন চায় না”। তারপরে কী হবে সেটা অনুমানের বিষয় নয়, উপলব্ধির বিষয়।’


সিমু নাসের লিখেছেন, ‘ফেসবুকে প্রচুর স্ট্যাটাস দেখলাম যে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর আরেকজন ভোট দিয়ে দিচ্ছে। বুথে ঢুকে আমার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে, সেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে কেন্দ্রে গেলাম। দেখি আহত-নিহত না হয়ে আমার ভোটটা আমি দিতে পারি কি না। একটা চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দেওয়া তো ঠিক হবে না। কেন্দ্রে গিয়ে দেখি, গিজগিজ করছে একটি নির্দিষ্ট দলের লোকজন। সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠতে গিয়ে দেখি, গেটে পুলিশ, আনসার এবং কর্মীদের একটা জটলা। ঢুকতে যাওয়ার মুখে বাধা পেলাম তরুণ কর্মীদের। বলল, ভাই লাইনে দাঁড়ান। আমি কোনো লাইন দেখতে পেলাম না। বললাম, লাইন কোনটা ভাই? তাঁরা তখন তিনজনই একটা লাইনের ফরম তৈরি করল। আমি চতুর্থজন হিসেবে তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম ভেতরে ভোটার তেমন নেই। ভেতর থেকে দুই তিনজন হাঁক দিল, এই লাইন লম্বা করে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাও, লোকজন কই? সেই হাঁকে সাড়া দিয়ে ভেতরে বেঞ্চে বসা ৮-১০ জন তরুণ আমার সামনে-পেছনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি তাঁদের ঠেলা খেতে খেতে মোটামুটি সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে (ওপর থেকে নিচের দিকে) চলে এলাম। আমি ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। আমি দেখতে চাই এই লাইন একই জায়গায় কতক্ষণ তারা ধরে রাখে।

১০ মিনিট-২০ মিনিট যায়, ভেতরের লোকজন আগের মতোই থাকে। আমাদেরও আর ঢোকা হয় না। আমার সামনের ছেলেগুলো একটু পর পর আমার দিকে তাকিয়ে আবার মোবাইলে গেম খেলতে থাকি। এর ভেতর দুজন জিজ্ঞেস করল কয় নম্বর কক্ষে আমার ভোট। বললাম। এই পুরোটা সময়ে একটা নির্দিষ্ট দলের এজেন্টরা বিভিন্ন লোকজনকে নিয়ে আমার পাশ দিয়েই কেন্দ্রের রুমে ঢুকছে, বের হচ্ছে। আমার প্রস্তুতি আছে লম্বা সময়ের, তাই সেসব নিয়ে প্রতিবাদ করলাম না।

আধা ঘণ্টা হবে। ভেতর থেকে পাতি গোছের একজন লাইনের মধ্যে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমার সঙ্গে আসেন। লাইনের অন্যরা সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি মনে মনে ভাবলাম, খাইছে রে, কী জানি আছি আজকে কপালে। আমি তার সঙ্গে হাঁটা দিলাম। কিন্তু লাইনের শুরুর ছেলেটা আবার আমাকে আটকাল। কিন্তু আমি চোখ দিয়ে সেই পাতি নেতাকে দেখালাম। পাতি নেতাও ইশারা দিলেন। আমাকে ছেড়ে দিল সে। পাতি নেতা আমাকে আমার ৪ নম্বর কক্ষে নিয়ে গেলেন। আমি ভোটার নম্বর বললাম, এক কর্মকর্তা লিস্টে আমার নাম খুঁজে বের করে হাতে কালি লাগালেন। কর্মকর্তা তখন বললেন আঙুলের ছাপ দিতে। আমি দিলাম। ছবিসমেত তথ্য বেরিয়ে আসল। উনি বললেন, কাপড়ে ঘেরা জায়গায় গিয়ে ভোট দিতে। ওই পাতি নেতা পুরোটা সময় আমাকে গাইড করলেন। এবারও আমার সঙ্গে আসতেই মুখে হাসি ঝুলিয়ে তাঁকে বললাম, ভাই টেনশন নিয়েন না, আপনাদের জায়গা মতোই ভোট দেব, কিন্তু আমাকে একাই ভোট দিতে দেন। উনি থমকে দাঁড়ালেন। একটু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে যান। তাঁকে বাইরে রেখে আমি একাই ঢুকলাম।

বুথ থেকে বের হয়ে দেখি ওই নেতা আমার সামনেই দাঁড়ানো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। কিন্তু উনি হাসলেন না। কেন হাসলেন না কে জানে! নিশ্চিত জয়ের মুখে এমন মুখ কালো করার কারণ কী তাঁর---ভাবতে ভাবতে বের হচ্ছি রুম থেকে, তখন কানে এল তাঁর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর---তিনটা বাজে সময় তো আর নাই বেশি। প্রিসাইডিং অফিসারও কী জানি একটা জবাব দিলেন, কিন্তু সেটা আমি শুনতে পেলাম না।’

রিতু লিখেছেন, ‘স্মার্ট লোক দেখলেই বোঝা যায় এর ভোটটা দিয়ে দেওয়া যাবে না। তাই কিছু স্মার্ট লোক নিজের ভোট নিজে দিয়ে বের হতে পারেন। স্মার্ট লোকেরা ভাবে অন্য সবাই তাদের মতো স্মার্ট বা তাদের চলাফেরায় যে আধিপত্য আছে তা সবারই আছে। দেশের কত শতাংশ মানুষ যে বোকার মতো অন্যদের বিশ্বাস করে আর জোচ্চুরি দেখে অবাক হয়, তা এই স্মার্ট লোকজন চিন্তাই করতে পারে না।’

আফসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘নির্বাচনে যেই জিতুক অবস্থার উন্নতি হওয়ার চান্স কম। তবে ইলেকশনের আওয়াজ বন্ধ করার জন্য ধন্যবাদ। ওটাই যথেষ্ট।’

চারু হক লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রের নামে যা কিছু আছে বাংলাদেশে, সেটা একান্তই নির্বাচন কেন্দ্রিক। কিন্তু নির্বাচনের নামে যে ঘটনা ঘটে সেটা শতভাগ দুর্নীতি কেন্দ্রিক। এর শুরুটা হয় মনোনয়ন পর্ব থেকে; কাকে, কেন এবং কীভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়ে থাকে—সেটা সবাই জানে। এরপর দুর্নীতির লিখিত নমুনা গড়ায় হলফনামায়। যেখানে ২৯ লাখ টাকার ঘড়ি পরা ওবায়দুল কাদেরকে নিজের ঘরবাড়ি না থাকায় স্ত্রীর বাড়িতে থাকতে দেখা যায়, ফখরুল ইসলামকে স্ত্রীর গাড়িতে ঘুরতে হয়, এমনকি দেড় ডজন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক আতিকুল ইসলামকেও নিজের গাড়ি না থাকায় অন্যদের গাড়িতে গড়াগড়ি খেতে দেখা যায়। গাড়ি থাকবেই বা কী করে, আতিকুলের হাতে নাকি নগদ ১ লাখ টাকাও নাই! অথচ এঁদেরকেই দেখা যাবে একেকটা নির্বাচনী বৈতরণি উতরাতে শত কোটি টাকা খরচ করে ফেলতে। এরপর তাঁরা সেই টাকা উশুল করার অজুহাতে সমূহ দুর্নীতির সরকারি আশকারা কাজে লাগাবেন। এভাবে, নির্বাচন কেন্দ্রিক দুর্নীতির কারণে দেশ ও জনগণ দুর্নীতির দুষ্টুচক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে। অবশ্যই এই দুষ্টুচক্র চালিয়ে নিতে সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তা না হলে, ক্ষমতার গদিতে যাওয়ার আগে জেলখানায় যেতে হতো এই সব তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের।’

স্বপ্নময়ী দিনা লিখেছেন, ‘মাত্র ভোট দিয়ে আসলাম। হ্যাঁ আমার ভোট আমি দিতে পেরেছি। যদিও ভোটারের উপস্থিতি সংখ্যা কম। তবে আমাদের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড মণিপুর অঞ্চলের প্রায় ১০টি ভোট কেন্দ্রে কোনো রকম গন্ডগোল হয়নি। যদিও অনেক জায়গার ভোটাররা শুধু নাকি আঙুলের ছাপ দিতে পেরেছেন। কিন্তু ভোট দিতে পারেননি—এই খবর শুনলাম। আমার মনে হয় শতকরা ৩০ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছে। আমার যদিও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ফেসবুকে দেখলাম বন্ধু বান্ধবীরা ভোট দিয়ে এসে একটা পোস্ট দিয়েছে। তাই আমিও প্রায় বিকেল তিনটার দিকে গুটি গুটি পায়ে ভোট কেন্দ্রের দিকে গেলাম। প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট দিলাম।’

ইমতিয়াজ ইকরাম ভোটের কালি মাখানো আঙুলের ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘ভেবেছিলাম ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেব আজকে, শেষে ইভিএম সিস্টেম দেখার লোভে ভোট দিয়ে আসলাম।’

নির্বাচনী পোস্টার বিষয়ে ইঙ্গিত করে জি এইচ হাবীব লিখেছেন, ‘কোরবানির বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা পাই, দু-এক দিনের মধ্যে সেই বর্জ্য সরিয়েও ফেলা হয়। নির্বাচন-বর্জ্য অপসারণের কী হবে?’

প্রীতি ওয়ারেসা ভোটারদের সচেতনতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একজন মহল্লাবাসী হিসেবে মেয়রের চেয়ে কমিশনারকে চেনা গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকাবাসী ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আন্ধাকুন্দা সিল মারে, ব্যক্তিগতভাবে কাউকেই চেনে না কেবল মার্কা ছাড়া।’