অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন আজ

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রোববার সকালে শেষ মুহূর্তে চলছে। ছবি: আদর রহমান
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রোববার সকালে শেষ মুহূর্তে চলছে। ছবি: আদর রহমান

প্রতীক্ষার অবসান হতে চলল। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। দেশের লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের নিয়ে সবচেয়ে আয়োজন অমর একুশের গ্রন্থমেলার উদ্বোধন হবে আজ রোববার। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতিজড়িত মাস ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় দিনের বিকেলে বাংলা একাডেমি চত্বরে মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে এবারের বইমেলা। আয়তনের দিক থেকে এবারের মেলা হবে বৃহৎ আয়োজন।

আজ সকালে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে মিলল মাঘের হিমেল বাতাসে রঙের ঝাঁজালো ঘ্রাণ। বাঁশ-কাঠের স্তূপ কোথাও কোথাও। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া আর তেমন কাউকে দেখা গেল না। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন প্রতিনিধির অনুমতি নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, বর্ণিল সাজে সেজেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাঙালির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত উৎসবের আমেজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণ থেকে উৎসবের আমেজ। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণ থেকে উৎসবের আমেজ। ছবি: প্রথম আলো

বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, আজ বিকেলে বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী মেলা পরিদর্শন করবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন সংস্কৃতিসচিব আবু হেনা মোস্তফা কামাল। স্বাগত বক্তব্য দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ বঙ্গবন্ধু রচিত তৃতীয় বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমি প্রকাশিত এই গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করবেন।

এবার বইমেলার একটি নতুন থিম নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তা হলো ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ’। স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে মেলার আঙ্গিক ও সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন। দেখা গেল জাতির পিতাকে সম্মান জানাতে শোভা পাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত ফেস্টুন, পোস্টারসহ নানা কিছু। মেলার বিন্যাসে নান্দনিকতার ছাপ। বৃহৎ পরিসর হওয়ায় বইপ্রেমীরা এবার স্বাচ্ছন্দ্যে মেলায় ঘুরতে এবং পছন্দের বই কিনতে পারবেন বলে আশা করছেন আয়োজকেরা। গ্রন্থমেলা ২ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯ টা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত ৮ টা ৩০মিনিট পর্যন্ত মেলা চলবে।

এর আগে গতকাল শনিবার সকালে গ্রন্থমেলার সর্বশেষ প্রস্তুতি ঘুরে দেখেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। গ্রন্থমেলা ঘুরে দেখা যায়, স্টল ও প্যাভিলিয়নের নির্মাণকাজ শেষ। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘এবার বইমেলার সাজসজ্জা ও স্টল বিন্যাস খুব সুন্দর হয়েছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে নান্দনিকভাবে সাজানো হয়েছে মেলা। আশা করি, এবার বইমেলা জমজমাট হবে।’

গ্রন্থমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য ছয়টি পথ থাকবে। ছবি: প্রথম আলো
গ্রন্থমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য ছয়টি পথ থাকবে। ছবি: প্রথম আলো

গত ৩০ জানুয়ারি বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এবারের মেলার সার্বিক পরিকল্পনা তুলে ধরে মেলা কর্তৃপক্ষ। এ সময় জানানো হয়, এবার একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাড়ে আট লাখ বর্গফুট জায়গায়। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৯৪টি ইউনিটসহ মোট ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৭৩টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ৩৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ৩৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। ১৫২টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ এবং ৬টি উন্মুক্ত স্টল দেওয়া হয়েছে। একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বাংলা একাডেমির দুটি প্যাভিলিয়ন, চার ইউনিটের দুটি, একাডেমির শিশু-কিশোর উপযোগী বইয়ের জন্য একটি এবং একাডেমির সাহিত্য মাসিক ‘উত্তরাধিকার’-এর একটি স্টল থাকবে। এবারও শিশুচত্বর মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। এই কর্নারকে শিশু-কিশোরদের বিনোদন ও শিক্ষামূলক উপকরণে সজ্জিত করা হয়েছে। মাসব্যাপী গ্রন্থমেলায় এবারও ‘শিশুপ্রহর’ থাকছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকছে। গ্রন্থমেলার প্রচার কার্যক্রমের জন্য তথ্যকেন্দ্র থাকবে বর্ধমান ভবনের পশ্চিম বেদিতে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এ ছাড়া মেলায় আসা মানুষের বসার স্থান তৈরি করা হয়েছে। থাকছে ফুড কোর্টসহ বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের জন্য নানা আয়োজন।

গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রবেশের জন্য তিনটি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য ছয়টি পথ থাকবে। বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য প্রবেশের বিশেষ ব্যবস্থা করা হবে।

আগামীকাল ৩ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ২৫টি নতুন বই নিয়ে আলোচনা করা হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহ্যবাহী একুশে বক্তৃতা।

মেলার বিন্যাসে নান্দনিকতার ছাপ থাকছে এবার। ছবি: প্রথম আলো
মেলার বিন্যাসে নান্দনিকতার ছাপ থাকছে এবার। ছবি: প্রথম আলো

এ ছাড়া মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রতিদিনই রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ এবং আবৃত্তি। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে।

অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০১৯ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০১৯ গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।

এ ছাড়া ২০১৯ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। আয়োজক সূত্রে জানা গেছে , প্রতিবছরের মতো এবারও হুইল-চেয়ার সেবা থাকবে। তবে গতবারের চেয়ে বেশি সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবী এ-কাজে নিয়োজিত থাকবেন। এবার হুইল চেয়ারের সংখ্যা বাড়বে।

গ্রন্থমেলার প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে পর্যাপ্তসংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিরাপত্তাকর্মীরা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলার এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রন্থমেলা সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত। মেলা প্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে থাকছে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা।