নিরাপদ সবজির গ্রাম সোনাখুলি

বিষমুক্ত টমেটোখেতে চাষি সুভাষ চন্দ্র রায়। গতকাল সৈয়দপুরে। ছবি: প্রথম আলো
বিষমুক্ত টমেটোখেতে চাষি সুভাষ চন্দ্র রায়। গতকাল সৈয়দপুরে। ছবি: প্রথম আলো

মানুষকে বিষমুক্ত শাকসবজি খাওয়ানোর সংকল্পে একজোট হয়েছেন একটি গ্রামের সব কিষান-কিষানি। গত শীত মৌসুম থেকে সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব, রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক বালাইনাশক ছাড়াই নিরাপদ সবজি আবাদ করছেন তাঁরা। এতে উৎপাদন একটু কম হলেও মানুষকে বিষমুক্ত শাকসবজি খাওয়াতে পারছেন—এই ভেবে গর্বিত তাঁরা।

এই কৃষকেরা সবাই নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ি ইউনিয়নের সোনাখুলি হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা। এই প্রচেষ্টার কারণে গ্রামটি এখন ‘নিরাপদ সবজির গ্রাম’ বা ‘অরগানিক কৃষি গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। প্রায় ২০ জন কিষান-কিষানি এবার তাঁদের জমিতে চাষ করেছেন বিষমুক্ত শাকসবজি।

গতকাল রোববার সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের চারদিক সবুজ সবজির খেতে ভরা। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৈয়দপুর কৃষি বিভাগের পরামর্শে গ্রামের ছয় একর জমিতে চাষ হচ্ছে বিষমুক্ত নানা রকম সবজি। আলু তুলে নেওয়ার পর বর্তমানে জমিতে রয়েছে শিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, ধনেপাতা, বেগুন ইত্যাদি।

এই কৃষক দলের একজন সুভাষ চন্দ্র রায় (৩০)। তিনি বলেন, ‘আগে আমরা জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতাম। কীটনাশক স্প্রে করতাম। এর মাধ্যমে বহু বছরহাইব্রিড জাতের শাকসবজি আবাদ করেছি। এতে ফলন বেশ ভালো হতো। তবে আমরা জানাতাম না,এসব ফসল বিষাক্ত এবং এসব খেয়ে মানুষেরা নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতেন।আমরা কৃষি বিভাগের কাছ থেকে জানতে পারি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োগে জমির ফসল বিষে পরিণত হয় এবং মাটি উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলে। আমরা গেল বছর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আর মানুষকে বিষ খাওয়াব না। বর্তমানে আমাদের গ্রামের সবাই নিরাপদ সবজি আবাদের সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন।’

গ্রামটির প্রবেশমুখেদেখা যায়, চাষিরা সম্মিলিতভাবে গর্ত খুঁড়ে গৃহস্থালি বর্জ্য দিয়ে তৈরি করছেন কম্পোস্ট সার। একটু দূরেই তৈরি হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জৈব বালাইনাশক। এসব ফসলের জমিতে প্রয়োগ করে মিলছে ভালো ফল। জানা যায়, কিষানি মায়া রানী রায় (৩৪) কেঁচো সার তৈরিতে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় জৈবপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করেন তিনি। এ সার জমিতে প্রয়োগ করলে অনেক ভালো ফলন মেলে বলে জানান মায়া রানী।

কিষানি আলো রানী (৪২) বলেন, ‘কৃষি বিভাগ থেকে জৈব চাষাবাদ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছি আমরা। ফসলের পরাগায়ন কীভাবে ঘটাতে হয়, তা এখনআমরা জানি। প্রকৃতির কাছে আশায় না থেকে পরাগায়ণ প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। এতে ফসল পুষ্ট হচ্ছে।’

জৈবপদ্ধতিতে চাষাবাদ করা জমিগুলো ঘুরে দেখা যায়, খেতের মাঝে মাঝেস্থাপন করা হয়েছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ। এটি হচ্ছে কীটপতঙ্গ দমনের জৈবপদ্ধতি। সেক্স ফেরোমন ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এটি প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত, যা মানুষ বা পরিবেশের কোনোরূপ ক্ষতি করে না। সুতরাং এটি পরিবেশবান্ধব। এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিক বক্স ব্যবহার করা হয়। যার দুই পাশে তিন কোনা ফাঁক থাকে। পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করতে স্ত্রী পোকার শরীর থেকে নিঃসৃত এক রকম প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থ বা স্ত্রী পোকার গন্ধ ব্যবহার করা হয় ফাঁদে। এর আকর্ষণে পুরুষ পোকা ফাঁদের দিকে ধেয়ে আসে এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। এতে জমির ফসল নিরাপদ থাকে। অতীতে এসব কীট দমনে ব্যবহৃত হতো বিষাক্ত কীটনাশক। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ বা গন্ধফাঁদব্যবহার করায় জমির ফসল নিরাপদ থাকছে। খাদ্যমান ও পুষ্টি সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।

সূত্রমতে, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে খরচ একটু বেশি হয়। সুভাষ জানান, জৈবপদ্ধতিতে১০ শতক জমিতে করলা উৎপাদনে তাঁর খরচ হয়েছে ৪ হাজার টাকা। এ থেকে মিলেছে ৫৭০ কেজি করলা, যা বেঁচে তিনি আয় করেছেন ১৪ হাজার টাকা। এদিকে ২০ শতক জমিতে টমেটো উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। এ থেকে উৎপন্ন হবে প্রায় ১০০ মণ টমেটো। কম করে হলেও প্রতি মণ টমেটোর দাম ১ হাজার টাকা ধরে সে ক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা খরচ করে পাওয়া যাবে ১ লাখ টাকা।

কৃষি বিভাগ বলছে, নিরাপদ সবজি বাজারজাত করতে সরকার এরই মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঢাকায় গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপদ কৃষিবাজার। শিগগিরই নীলফামারী জেলায় এ ধরনের বাজার সৃষ্টি করা হবে, যেখানে ১২ মাস নিরাপদ সবজি পাওয়া যাবে।

এ নিয়ে কথা হয় সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান,‘নিরাপদ কৃষি গ্রাম হচ্ছে একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। দেশের প্রতিটি উপজেলায় এ ধরনের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কৃষিকে বিষমুক্ত করতেই এই উদ্যোগ। আমরা সৈয়দপুরেগেল বছর থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ওই ‘অরগানিক কৃষি গ্রাম’ গড়ে তুলেছি। এতে কৃষকের সাড়া মিলছে প্রচুর।’