সবাই মিলে দখল করছে বনের জমি

বহেড়াতৈল রেঞ্জের এমএমচালা বিটের আওতায় পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সানবান্ধা এলাকায় বনের জমিতে নির্মিত একটি বাড়ি।  ছবি: প্রথম আলো
বহেড়াতৈল রেঞ্জের এমএমচালা বিটের আওতায় পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সানবান্ধা এলাকায় বনের জমিতে নির্মিত একটি বাড়ি। ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার একর বনের জমি জবরদখল হয়ে গেছে। দখলের তালিকায় বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বাজারসহ হাজারো ব্যক্তির নাম রয়েছে।

যুগ যুগ ধরে এভাবে বনের জমি দখল হওয়ায় একদিকে বনভূমি কমছে, অন্যদিকে দিন দিন উজাড় হচ্ছে বন। ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। হারিয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণী ও কীটপতঙ্গ।

বন বিভাগ বলছে, একদিনে বনভূমি দখল হয়নি। একটু একটু করে অন্তত ৫০ বছরে এসব জমি জবরদখল হয়েছে। এখন জবরদখল হওয়া জমিগুলো পর্যায়ক্রমে উদ্ধার করে তা বন বিভাগের দখলে নেওয়া হচ্ছে।

উপজেলায় বন বিভাগের বহেড়াতৈল রেঞ্জে ৫টি, হতেয়া রেঞ্জে ৫টি, বাঁশতৈল রেঞ্জে ১টিসহ মোট ১১টি বিট কার্যালয়ের অর্ধশত কর্মকর্তা, বন প্রহরী বন ও বনভূমি রক্ষায় নিয়োজিত থাকলেও দখল ঠেকাতে পারছেন না। তবে বন কর্মকর্তাদের দাবি, কিছু কিছু জমি উদ্ধার করে সামাজিক বনায়ন করা হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উপজেলায় আনুমানিক ২০০ একর জমি উদ্ধার করে বন বিভাগের কবজায় আনা হয়েছে।

বন বিভাগের রেঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বহেড়াতৈল রেঞ্জের ৫টি বিট কার্যালয়ের আওতায় ২০ হাজার ৮৭৮ দশমিক ৭৬ একর গেজেটভুক্ত বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে জবরদখলে আছে ৪ হাজার ২৬৪ দশমিক ৩৬ একর। হতেয়া রেঞ্জের ৫টি বিটের আওতায় ১৪ হাজার ৮৬৮ দশমিক ৩৭ একর গেজেটভুক্ত বনভূমির ৭ হাজার ১১৩ দশমিক ৬৩ একরই জবরদখলে রয়েছে। বাঁশতৈল রেঞ্জের ৫টি বিটের মধ্যে শুধু নলুয়া বিটটি সখীপুর উপজেলায় পড়েছে। এই বিটের আওতায় ২ হাজার ৪০০ একর বনভূমির মধ্যে প্রায় ১ হাজার একর ভূমি জবরদখলে রয়েছে। উপজেলার সীমানার মধ্যে ১১টি বিটে প্রায় ৩৮ হাজার বনভূমির মধ্যে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ভূমি বেদখলে। অর্থাৎ সখীপুরে মোট বনভূমির ৩ ভাগের ১ ভাগই বন বিভাগের দখলে নেই।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতাসংগ্রামের পর থেকেই পর্যায়ক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে দরিদ্র পর্যায়ের লোকজন বন বিভাগের জমিতে বাড়িঘর করতে থাকেন। প্রথমে একটি ঘর, পরে আস্তে আস্তে ওই বাড়িতে চার-পাঁচটি ঘর করে বনের জমি দখল হতে থাকে। বনের জমিতে বাড়িঘর হতে হতে ৫০-৬০টি পরিবার মিলে সেখানে মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন উপাসনালয় গড়ে তোলে। প্রয়োজনের তাগিদে পর্যায়ক্রমে বাজার, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বনের জমি দখল করে স্থাপিত হয়।

সম্প্রতি বহেড়াতৈল রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে রেঞ্জের জমির নকশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বহেড়াতৈল মৌজার নকশার ৭ নম্বর সিটের ১৫২৯ দাগে বনের জমির পরিমাণ ২০৯ দশমিক ৬০ একর। ওই দাগে আনুমানিক ১০০ একর জমি বন বিভাগের দখলে নেই।

বহেড়াতৈল রেঞ্জের আওতায় বনের ৫০ শতক জমি দখল করে স্থাপিত ছাতিয়াচালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।  ছবি: প্রথম আলো
বহেড়াতৈল রেঞ্জের আওতায় বনের ৫০ শতক জমি দখল করে স্থাপিত ছাতিয়াচালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছবি: প্রথম আলো

এই জমি কে কে দখলে রেখেছেন, এমন প্রশ্নে রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ বলেন, দাগের বেশির ভাগ জমিই সখীপুর পৌরসভার সীমানায়। ফলে জমির মূল্য অনেক বেশি। বর্তমানে এ জমিতে কয়েক শ বাড়ি, সিএমইএস নামের একটি বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞান আনন্দকেন্দ্র, কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ, একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমপক্ষে তিনটি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা, একটি ফুটবল মাঠসহ অনেক স্থাপনা রয়েছে।

সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান লুৎফর রহমান বলেন, বনের গাছপালা কেটে সাফ করে সেখানে বাজারসহ নানা স্থাপনা বসানো হচ্ছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বন উজাড় হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। হারিয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণী ও কীটপতঙ্গ। এভাবে বন ধ্বংস করে স্থাপনা হতে থাকলে একসময় পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাঁশতৈল রেঞ্জের আওতাধীন নলুয়া বিট কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম জানান, তাঁর এলাকায় প্রায় ২০ বছর আগে প্রায় দুই একর জমি দখল করে এয়ারফোর্স বাজার নামে একটি বাজার হয়েছে। এখন ইচ্ছা করলেও এই বাজার বন বিভাগের কবজায় নেওয়া সম্ভব নয়।

বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বনের জমি দিন দিন দখল হচ্ছে, এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হতেয়া রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. আবদুল ওয়াদুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে অনেক জমি উদ্ধার করে সেখানে বনায়ন করেছি।’ এত জমি জবরদখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একদিনে জবরদখল হয়নি। একটু একটু করে ৫০ বছরে এসব জমি জবরদখল হয়েছে।

টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘জবরদখল হওয়া জমিগুলো পর্যায়ক্রমে উদ্ধার করে তা বন বিভাগের দখলে নেওয়া হচ্ছে। এ বছরও প্রায় ২০০ হেক্টর জমি আমরা দখলমুক্ত করে সেখানে সামাজিক বনায়ন করেছি।’