সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হেনস্তা চলছে

রক্তাক্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আগামীনিউজডটকমের সাংবাদিক মুস্তাফিজুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো
রক্তাক্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আগামীনিউজডটকমের সাংবাদিক মুস্তাফিজুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো

সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে সাংবাদিকদের ওপর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা করেছে। নির্বাচনের দিন তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে মারধর, হেনস্তা ও রক্তাক্ত হয়েছিলেন অন্তত ছয় সাংবাদিক। এবার বাড্ডার বেরাইদ এলাকায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন বেসরকারি টেলিভিশন মাছরাঙার রিপোর্টার হাসনায়েন তানভীর ও ক্যামেরাপারসন সাইফুল ইসলাম। আজ সোমবার সেখানকার ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের নব নির্বাচিত কাউন্সিলর আইয়ুব আনছারের সমর্থনকরা তাদের ওপর হামলা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে পুলিশ মহাপরিদর্শকের আশ্বাসের পরও সাংবাদিকদের ওপর হামলার এসব ঘটনায় আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বরং হামলাকারীরা আহত সাংবাদিকদের হুমকি দিচ্ছেন। শনিবার গেন্ডারিয়া এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সহসভাপতি শহিদুল আলমের হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন তিন সাংবাদিক। এ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করায় পরদিন তাদের বিরুদ্ধেই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ওই নেতা।

রক্তাক্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আগামীনিউজডটকমের সাংবাদিক মুস্তাফিজুর রহমানের অভিযোগ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শেখ মোহাম্মদ হোসেনের সমর্থকেরা শনিবার তাকে পিটিয়েছিল। কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়ে রোববার তাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছিলেন ওই কাউন্সিলর। সে সময় তিনি মামলা না করার ‘পরোক্ষ হুমকি’ দিয়ে গেছেন।

সাংবাদিকদের ওপর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অব্যাহত এসব হামলার ঘটনায় বিবৃতি ও নিন্দা জানিয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো। শনিবার বিবৃতি দিয়েছিলেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতারা। আজ সোমবার বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা।

হামলার শিকার মাছরাঙার সাংবাদিক

নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ করতে গতকাল সোমবার বাড্ডার বেরাইদ এলাকায় গিয়েছিলেন স্টাফ রিপোর্টার হাসনায়েন তানভীর এবং ক্যামেরাপারসন সাইফুল ইসলাম। এ সময় স্থানীয় সাংসদ এ কে এম রহমতুল্লাহর ভাগনে ও নব নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর আয়ুব আনছারের সমর্থকেরা তাদের ওপর হামলা চালায়। তারা মাছরাঙা টিভির গাড়ি ভাঙচুর করে এবং ক্যামেরা থেকে মেমোরি কার্ড ছিনিয়ে নেয়।

হাসনায়েন তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, কাউন্সিলর হিসেবে বিজয়ী হাওয়ার পর আয়ুব আসছারীর সমর্থকেরা ওই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও তার সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর করেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছের বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে ওই এলাকায় গিয়েছিলেন তারা। ভাঙচুর করা হয়েছে এমন তিনটি বাড়ির পরিস্থিতি ভিডিও করে তারা যখন গাড়িতে উঠে ফিরছিলেন তখনই তাদের ওপর হামলা করা হয়। হামলাকারীরা নিজেদের আয়ুব আনছারের ‘লোকজন’ বলে পরিচয় দিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আয়ুব আনছার প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তার লোকজন এর সঙ্গে জড়িত নয়। কারা করেছে তা তিনি শনাক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. পারভেজ ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পরপরই তারা সেখানে গিয়ে সাংবাদিকদের উদ্ধার করেন। নবনির্বাচিত কাউন্সিলর এবং সদ্য সাবেক কাউন্সিলর এসেছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছিল। আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যে খোয়া যাওয়া মেমোরি কার্ড ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন কাউন্সিলর। এরপর সাংবাদিকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করলেন সাংবাদিক

গত শনিবার রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থী ও তার বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্টার মাহবুব মমতাজী এবং দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর নুরুল আমিন জাহাঙ্গীর। এই দুজনসহ স্থানীয় পত্রিকা দিন প্রতিদিনের রিপোর্টার পাপনকে হেনস্তা করেছিলেন ছাত্রলীগের গেন্ডারিয়া থানার সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সহসভাপতি শহিদুল আলমের শহিদুল আলম ওরফে রিয়াদ। পরদিন ওই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ওই নেতা। জিডিতে এই সাংবাদিকদের ‘জামায়াতের এজেন্ট’ বলে তকমা দিয়েছেন তিনি। দাবি করেছেন, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে।

শহিদুলের জিডির প্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার বিকেলে নিরাপত্তা চেয়ে গেন্ডারিয়া থানায় পাল্টা জিডি করেছেন সাংবাদিক নুরুল আমিন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, শনিবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে ভোটের তথ্য সংগ্রহ করার গেন্ডারিয়ার জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় গিয়েছিলেন তারা। এ সময় একটি কক্ষ থেকে হট্টগোলের শব্দ পেয়ে তারা এগিয়ে যান। সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরেই ছাত্রলীগ নেতা শহিদুল তাদের মুঠোফোন কেড়ে নেন। এরপর টেনে হিঁচড়ে কেন্দ্র থেকে বের করেন। তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ সময় কর্তব্যরত পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ওয়ারী অঞ্চলের সহকারী কমিশনার হান্নানুল ইসলামকে জানালে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাদের মুঠোফোন উদ্ধার করে দেন।

হেনস্তার পরও ছাত্রলীগ নেতার জিডির বিষয়ে জানতে চাইলে গেন্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাজু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি থানায় ছিলেন না। কর্তব্যরত পুলিশ জিডিটি নিয়েছেন। ওই জিডির প্রেক্ষিতে তারা কোনো পদক্ষেপ নেবেন না।

এদিকে গতকাল শহিদুলকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে সংগঠনটির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত ০১ ফেব্রুয়ারি সংগঠিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জড়িত থাকায় ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শহিদুল ইসলাম খান রিয়াদকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।