আনন্দের মেলায় উষ্ণতা

এবার মেলায় ঢুকে প্রথমেই মনে হলো দুই পাশের স্টলের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটি, তা অনেক প্রশস্ত। এখানে হাঁটতে গিয়ে কারও সঙ্গে ঠোকাঠুকি হবে না।

পড়ন্ত বিকেলে মৃদুমন্দ হাওয়ার মধ্যে যাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায়, তাঁদের বেশির ভাগই যে আজ বই কিনতে আসেননি, সে রকমই একটা আভাস পাওয়া গেল। সেটাই স্বাভাবিক। প্রথমে মেলাদর্শন, পরে পত্রপত্রিকায় দেখে অথবা বিজ্ঞাপনের সাহায্যে বই নির্বাচন এবং মেলা যখন মাসের শেষের দিকে গড়ায়, তখন বই কেনার হিড়িক পড়ে যায়।

কিন্তু দেখা গেল অনেকের হাতেই বইয়ের ব্যাগ! অর্থাৎ কিনব কি কিনব না করতে করতেই কেউ কেউ কিনে ফেলেছেন বই।

কোথাও কোথাও স্টল বানানোর ঠুকঠুক চলছিল, তবে বেশির ভাগ স্টল এরই মধ্যে পরিপাটিভাবে সেজেছে। যাঁরা বই বিক্রি করবেন বলে স্টলে শামিল হয়েছেন, তাঁরাও বেশ আনন্দিত মনে স্টল সামলাচ্ছেন। কেউ কেউ স্টলের সামনে দিয়ে হাঁটতে দেখে বলে যাচ্ছেন কী কী নতুন বই আছে তাদের।

মেলার এক পাশে আইনস্টাইনের জীবনী হাতে দাঁড়ানো একজনকে দেখে একটু দাঁড়াতে হয়। আইনস্টাইন কারণ নয়, কারণ হলো তিনি এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই মাথায় ফুলের মালা। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করি, এ আয়োজন তো ১৩ বা ১৪ ফেব্রুয়ারির! আপনারা আজ মাথায় ফুল রেখেছেন কেন?

তাঁরা জানান, জার্মানি থেকে যে বন্ধুটি এসেছেন, তিনি খুব শিগগির ফিরে যাবেন সে দেশে। ফলে যে কজন বন্ধু বইমেলায় আজ আসতে পেরেছেন, তাঁরা আনন্দে উদ্‌যাপন করছেন দিনটি।

এবার লিটলম্যাগপাড়াটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ধীরে ধীরে স্টলগুলো ভরে উঠছে ছোটকাগজ কিংবা বৈচিত্র্যময় কিছু বইয়ে। বাংলা একাডেমির ভেতর থেকে লিটলম্যাগ চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আনার দাবি ছিল তাঁদের। সে আশা পূরণ হয়েছে।

লেখক-সাহিত্যিকেরা এখনো খুব একটা আসছেন না, তবে আহসান হাবীব, সাইমন জাকারিয়া, জি এইচ হাবীব, সাখাওয়াত টিপুকে দেখা গেল মেলায়। আরও কেউ কেউ নিশ্চয়ই এসেছেন, কিন্তু এখনো স্টলে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া শুরু হয়নি।

চন্দ্রবিন্দু নামের প্রকাশনীতে তিন তরুণী বই বিক্রি করছেন। উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে তাঁরা বললেন, এবার মেলায় ম্যাগাজিন, বইসহ ৬০টি বই তাঁরা এনেছেন। বেশির ভাগই তরুণ লেখকদের।

একটা কোমল দৃশ্য মনকে প্রশান্তি দিল। দুই তরুণ ও দুই তরুণী ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন মেলায়। প্রাণবন্ত এই চারজন বিভিন্ন স্টলে যাচ্ছিলেন, বই দেখছিলেন। একটু একটু পড়ছিলেন এবং তারপর ছুটে যাচ্ছিলেন নতুন কোনো প্রকাশনীতে। তাঁদের নাম নার্গিস, কুমকুম, সাখাওয়াত আর রবি। এক ফাঁকে নামগুলো জেনে নেওয়ার আগে যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তাতেই মন ভালো হয়ে গিয়েছিল।

কুমকুম বলছিলেন, পড়েছি, বই কিনে কেউ কোনো দিন দেউলিয়া হয় না।

রবি বললেন, সে তো আমিও পড়েছি!

কুমকুমের উত্তর, কিন্তু তুই তো দেউলিয়া!

রবি বললেন, মানে?

কুমকুম বললেন, তুই একটাও বই কিনিসনি। আমাদেরও কিনে দিসনি। সুতরাং, তুই দেউলিয়া! বই যদি কিনতি, তাহলে দেউলিয়া হতি না।

বইমেলা তো শুধু বইয়ের মেলা নয়, নানা রকম আনন্দেরও মেলা।

প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে তরুণ বিক্রেতারা বিভিন্ন বই সাজিয়ে রাখছিলেন। একজন জানালেন, গত বছর মেলার পর ছাপা হওয়া বইগুলো সবই এসে গেছে। এ বছরের বইগুলো আসতে শুরু করেছে। তাঁরা টুকিটাকি বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের মধ্যে গল্প করে হালকা শীতকে পরাজিত করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন উষ্ণতার আমেজ।

মেলায় নতুন বই এসেছে ৩৭টি। এর মধ্যে প্রথমা প্রকাশন এনেছে আনিসুজ্জামানের সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি, কাজী মুরাদ অনূদিত লিও তলস্তয়ের হাজি মুরাদ। ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ এনেছে হাসান আজিজুল হকের আমার রবীন্দ্রযাপন। অন্যপ্রকাশ এনেছে আনা ইসলামের নভেরা বিভুঁইয়ের স্বভূমে। আগামী প্রকাশনী এনেছে মৌলি আজাদের বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে