এক থানাতেই ৭ মাসে ধর্ষণের ১৯টি মামলা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজশাহীর মোহনপুরে সাড়ে সাত মাসে নারী অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনার শিকার স্কুলশিক্ষার্থী। এক স্কুলছাত্রী অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যাও করেছে। পুলিশ প্রতিটি মামলাতেই আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। তবু এমন অপরাধের ঘটনা কমছে না।

 জানতে চাইলে মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণ ও ধর্ষণের যেসব মামলা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই স্কুলকেন্দ্রিক। তাই তিনি স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করছেন। সংশ্লিষ্ট আইন ও শাস্তির ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তবু একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে প্রতিটি ঘটনাতেই পুলিশ দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করেছে। সামনের দিনগুলোতেও এমন তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত মোহনপুর থানায় ওই ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ছিল অপহরণের মামলা। তদন্তের পর সেগুলো ধর্ষণের মামলায় রূপান্তরিত হয়েছে। একই সময়ে থানায় ধর্ষণচেষ্টার মামলা হয়েছে তিনটি।

সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৫ জানুয়ারি। ওই দিন দিবাগত রাতে দশম শ্রেণির এক মাদ্রাসাছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। ঘটনার দুই দিন পর মেয়েটির বাবা মোহনপুর থানায় মামলা করেন। ওই ছাত্রীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ২৮ জানুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণে স্থানীয় এক কলেজছাত্র জড়িত। প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় লোকজন বিষয়টি সালিসে মীমাংসার চেষ্টা করেন। তাঁরা ওই কলেজছাত্রের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু ছেলেটি বিয়ে করতে আপত্তি জানান। এরপর মেয়েটির বাবা থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে।

এর আগে গত ২২ জানুয়ারি সন্দেহভাজন এক ধর্ষক ও তাঁর সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে উপজেলার বাক্‌প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে ধর্ষণ ও তার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওই তরুণীর মা বাদী হয়ে মোহনপুর থানায় ২২ জানুয়ারি ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করেন। পরের দিন মেয়েটিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। ২০ জানুয়ারি রাতে উপজেলার এক গৃহবধূ (২৩) ধর্ষণের শিকার হন। তাঁর নগ্ন ছবি মুঠোফোনে ধারণ করেন অভিযুক্ত ব্যক্তি। পরে সেই ছবি এলাকায় উঠতি বয়সী তরুণ-যুবকদের মুঠোফোনে ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ জানুয়ারি ওই গৃহবধূ বাদী হয়ে থানায় ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করেন। ওই দিনই গৃহবধূকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

উল্লেখযোগ্য অন্য ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে গত ৩ আগস্ট দিবাগত রাতে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনা। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক কলেজছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে। অভিযোগ মোতাবেক, তিনি মেয়েটিকে অপহরণ করে রাজশাহী শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। এরপর কৌশলে মেয়েটিকে তার গ্রামের রাস্তার মোড়ে রেখে পালানোর চেষ্টা করেন। স্থানীয় লোকজন বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই কলেজছাত্রকে আটক করেন। খবর পেয়ে মোহনপুর থানা থেকে একদল পুলিশ গিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়।

গত ২ জুন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে অপহরণ করেন এক তরুণ। মেয়েটি রাত আটটার দিকে চাচার বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে যাচ্ছিল। রাস্তা থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর তাকে একটি বাড়িতে লুকিয়ে রাখা হয়। ১০ জুন সন্ধ্যায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বাড়িতে বিষয়টি মীমাংসার জন্য সালিস চলছিল। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করে ও আসামিকে আটক করে। পরে স্কুলছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে থানায় অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করেন।

গত ৭ জুন রাত ৮টার দিকে এক তরুণ একই গ্রামের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। তবে বিয়ে না করে নিজ বাড়িতে আটকে রেখে মেয়েটিকে রাতে ধর্ষণ করেন। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। তখন ওই তরুণ ও তাঁর পরিবারের লোকজন মেয়েটিকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন। মামলা না করার জন্য স্কুলছাত্রীসহ তার পরিবারকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ১০ জুন রাতে স্কুলছাত্রীর মা বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। ওই দিন রাতেই পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে।

এর আগে গত ১৬ মে অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার এক স্কুলছাত্রী অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় মামলা না নিয়ে উল্টো মেয়ের বাবাকে হেনস্তা করার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় তৎকালীন ওসি আবুল হোসেনকে মোহনপুর থানা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মেদ। ধর্ষণ ও অপহরণের মতো অপরাধ নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে আসছেন তিনি। নিজের একটি গবেষণার বরাত দিয়ে তানজির আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণের মামলায় কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের ওপরে গবেষণা চালিয়ে তিনি মানুষ কেন ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়ায়, তার কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। সামাজিকভাবে যারা নিজেদের জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না, তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোনো নারীকে লক্ষ্যবস্তু করে। আবার যারা নেশাসক্ত হয়ে পড়ে, তাদের বিচারবুদ্ধি লোপ পায়। তারা আইন-আদালতের শাস্তির কথা ভুলে গিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে বসে। এমন আরও কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

তানজির আহম্মেদের মতে, ধর্ষণ ও অপহরণের মতো অপরাধপ্রবণতার কারণগুলো বুঝে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলেই এমন ঘটনা কমে আসতে পারে। যেমন বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের বস্তু হিসেবে দেখা হয়। এমন ধারণা বদলাতে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। ঘৃণ্য এই অপরাধ ও এর কঠিন শাস্তির বিষয়ে উপযুক্ত প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।