প্রিয় তোয়ামণির জন্য অন্তহীন অপেক্ষা

সন্তানের হদিস চেয়ে ছবি হাতে অপেক্ষায় বাবা এরশাদ হোসেন। গতকাল কদমতলী এলাকার মোহাম্মদনগরে।  প্রথম আলো
সন্তানের হদিস চেয়ে ছবি হাতে অপেক্ষায় বাবা এরশাদ হোসেন। গতকাল কদমতলী এলাকার মোহাম্মদনগরে।  প্রথম আলো

কদমতলী থানা ছাড়িয়ে কিছু দূর এগোলেই মোহাম্মদনগর। এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়া খালটির নামও এলাকার নামেই। আবর্জনায় প্রায় বুজে আসা এই খালেই চার দিন আগে তলিয়ে গেছে ছয় বছরের শিশু তোয়ামণি। গত শনিবার ওই ঘটনার পর থেকেই খালের পাড়ে অপেক্ষায় আছে তোয়ামণির স্বজন, পাড়া–পড়শিরা। উদ্ধারকাজ চলছে। তবে সময় যতই যাচ্ছে, শিশুটিকে জীবিত উদ্ধারের আশা ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে। অন্তত সন্তানের স্পন্দনহীন দেহটিও যদি পাওয়া যায়, এখন সেই প্রতীক্ষায় খালপাড়ে বসে ছিলেন বাবা এরশাদ হোসেন।

মো. এরশাদ ও তানিয়া আক্তারের একমাত্র মেয়ে তোয়ামণি। শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার পর থেকে সে নিখোঁজ। তার খেলার সাথিরা জানিয়েছে, বিকেলে সবাই মিলে বাসার ঠিক পাশের ছোট্ট মাঠটায় ফুটবল খেলছিল। হঠাৎ বলটা খালে পড়ে যায়। তোয়ামণি ওটা তুলতে গিয়ে তলিয়ে যায়। একটা সময় ওরা শুধু তোয়ামণির উঁচিয়ে ধরা হাতটা দেখতে পেয়েছিল। পরিবারের লোকজনকে ছুটে গিয়ে ওরাই খবর দেয়। গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় বাসিন্দারা তোয়ামণির বাবার সঙ্গে ‘সন্তানের দেহ ফিরে পেতে অবস্থান’ কর্মসূচি পালন করেছেন।

মেয়ের ছবি হাতে এরশাদ হোসেন বসে ছিলেন খালপাড়ে। প্রথম আলোকে বলেন, তোয়ামণি নিখোঁজ হয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন। মেয়েটা ভারি চঞ্চল। হইহট্টগোলে পড়ে যেন আঘাত না পায়, সে কারণে বিশেষ সতর্ক ছিলেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। মুঠোফোনে কার্টুন ছেড়ে মেয়ের হাতে দিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনিও লাগিয়ে দিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন তিনি। একটা সময় দরজা খোলা পেয়ে সে বেরিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই খবর আসে তোয়ামণি তলিয়ে গেছে। গত ১১ জানুয়ারি তোয়ামণি ছয় বছরে পড়েছে। স্কুলেও ভর্তি হয়েছিল। মেয়েকে নিয়ে এমন টুকরো টুকরো কথা দিনভরই বলে চলছিলেন এরশাদ হোসেন। রাজমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে সদ্যই একটা কনফেকশনারির দোকান শুরু করেছেন। একটু একটু করে সচ্ছলতার মুখ দেখছিল পরিবারটি। এর মধ্যেই সন্তান বিয়োগের নিদরুণ আঘাত!

তোয়ামণি তলিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েই স্থানীয় বাসিন্দারা ৯৯৯–এ ফোন করেছিলেন। তবে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা ঘটনাস্থলে আসার আগেই ঝাঁপ দেন ফরহাদ আলম নামের স্থানীয় এক তরুণ। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওকে ভেসে যেতে দেখে তিনি (ফরহাদ) সাঁতরে পিছু নিয়েছিলেন। আধা মাইল পর্যন্ত এগোনোর পর তিনি আর তোয়ামণিকে দেখতে পাননি। ময়লা আবর্জনার স্তূপে প্রায় গতিহীন হয়ে পড়া খালটিতে কিছুটা দূরত্বে স্রোত ছিল বলেও জানান ফরহাদ। এলাকার লোকজন বলেন, খালটি সিদ্ধিরগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। শেষ হয়েছে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে। বড়জোর তিন কিলোমিটার পর্যন্ত খোঁজা হয়েছে।

তোয়ামণিকে খুঁজে পেতে অবিরাম খোঁজ চলছে এখন। পাড়া–প্রতিবেশী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরিরা খুঁজছেন। স্থানীয় কাউন্সিলর, সেনাবাহিনীর সদস্যরাও যোগ দিয়েছেন উদ্ধার অভিযানে। উদ্ধার অভিযান যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে, সে জন্য ঘটনাস্থলে আছে কদমতলী থানার পুলিশও। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঘটনা ঘটার পরপর প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দারা আরও বলেছেন, খালটি যদি নিয়মিত পরিষ্কার করা হতো তবে শিশুটিকে পলিথিন আর নোংরা–আবর্জনার স্তূপে তলিয়ে যেতে হতো না।

জন্মাবধি মোহাম্মদনগরের বাসিন্দা ওয়াহিদা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ৩১ বছরে এক দিনও তিনি খালটা কাউকে পরিষ্কার করতে দেখেননি। ওই অঞ্চলের সব মানুষ খালে আবর্জনা ফেলেন। বাজার–হোটেলের ময়লাও এখানেই ফেলা হয়। খালে পলিথিনের স্তূপ। প্রায়ই মনে হয় শক্ত জায়গা, নিচে পানির স্রোত বোঝা যায় না। তোয়ামণি সম্ভবত সেই চিন্তা থেকেই খালে নেমে গিয়েছিল। পরে তলিয়ে গেছে।

ঘটনাস্থলে কাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন পরিদর্শক মোহাম্মদ খবির খানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, খালের
দুই পাশে এমনভাবে স্থাপনা উঠেছে যে তাঁদের গাড়ি ময়লা নিতে পারে না। স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য এসব কথায় সন্তুষ্ট নন। তাদের পাল্টা প্রশ্ন, খালের ধার ঘেঁষে স্থাপনা উঠলে ময়লা নেওয়া যাবে না কেন?

তোয়ামণিকে না পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। যেন এক অন্তহীন প্রতীক্ষা করছিলেন তাঁরা শিশুটির জন্য।