আম ও ডাবের 'এত' ভোট

বাহারানে সুলতান ও আকতারুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত
বাহারানে সুলতান ও আকতারুজ্জামান। ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ বছর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) প্রার্থী বাহারানে সুলতান। তখন প্রায় প্রতিদিন গণসংযোগ করার পরও ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ৩১৩টি। এবারও তিনি মেয়র পদের প্রার্থী ছিলেন। তবে ভোটে ‘পাস’ করবেন না জেনে প্রচারই চালাননি তিনি। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ‘আম’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা এই প্রার্থী গতবারের চেয়ে ১০ গুণ ভোট বেশি পেয়েছেন।

বাহারানে সুলতানের প্রাপ্ত ভোট ৩ হাজার ১৫৫। তিনি কোনো পোস্টার লাগাননি, লিফলেটও বিতরণ করেননি। পেশায় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ব্যবসায়ী বাহারানে সুলতান ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি। প্রচারে না নেমেও এত ভোট পাওয়ার বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জনগণ পরিবর্তনের পক্ষে।

শুধু বাহারানে নন, গত সিটি নির্বাচনে ৩৬২ ভোট পাওয়া ‘ডাব’ প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আকতারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ এবার পেয়েছেন ২ হাজার ৪২১ ভোট।

জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করা জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র প্রার্থীর ভোট কিন্তু খুব একটা বাড়েনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জাপার মেয়র প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ ওরফে মিলন পেয়েছেন ৫ হাজার ৫৯৩ ভোট। গত সিটি নির্বাচনেও তিনি জাপার মেয়র প্রার্থী ছিলেন। তখন তাঁর ভোট ছিল ৪ হাজার ৫১৯টি।

প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে প্রচারে খুব বেশি সরব ছিলেন না জাপার সাইফুদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বেশি ভোট পেয়েছি, এটাই বেশি। নিরপেক্ষ ভোটারদের আশায় নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু ভোটাররা রাজনীতিবিদদের প্রত্যাখ্যান করেছেন।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জাপার প্রার্থীর ৫ গুণ বেশি ভোট পেয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আবদুর রহমান। তিনি পেয়েছেন ২৬ হাজার ৫২৫ ভোট। আর ঢাকা উত্তরে দলটির প্রার্থী শেখ ফজলে বারী পেয়েছেন ২৮ হাজার ২০০ ভোট। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির প্রার্থীদের পর তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা। গত সিটি নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে দলটির মেয়র প্রার্থী পান ১৮ হাজার ভোট। আর দক্ষিণের সিটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী পান প্রায় ১৫ হাজার ভোট।

১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র পদে লড়েন ১৩ প্রার্থী। ঢাকা দক্ষিণে (ডিএসসিসি) ৭ জন আর উত্তরে (ডিএনসিসি) ৬ জন। নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে জামানত হারিয়েছেন ৯ প্রার্থী। দুই সিটিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চার প্রার্থীই শুধু জামানত বাঁচাতে পেরেছেন।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০ অনুযায়ী, মেয়র নির্বাচনের ক্ষেত্রে ২০ লাখের বেশি ভোটারসংবলিত নির্বাচনী এলাকার জন্য জামানত ১ লাখ টাকা। মোট প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, তাহলে তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়।

জামানত হারালেও বেশ কয়েকজন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট বিস্মিত করেছে অনেককেই। আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ভোট পড়েছে তাঁদের পক্ষে। ভোটের এমন সংখ্যাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকেরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা অপরিচিত, যাঁদের কোনো রকম সমর্থন নেই, তাঁদের এত ভোট পাওয়া কিছুটা অস্বাভাবিক। নির্বাচন নিয়ে অনেক অভিযোগ, গুজব শুনছি। নির্বাচন ঘিরে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে, তার ফলাফল হতে পারে ভোটের এই সংখ্যা।’

মাছ প্রতীক পেয়েছে সাড়ে ১২ হাজার ভোট

দক্ষিণ সিটিতে গণফ্রন্টের মেয়র প্রার্থী ছিলেন আবদুস সামাদ। এবারই প্রথম মেয়র নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট। মাছ প্রতীকের প্রার্থীর এত সমর্থনে অনেকেই অবাক হয়েছেন।

তবে আবদুস সামাদের দাবি ‘ভোট ডাকাতি’ হওয়ায় তাঁর ভোট কমেছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ ভয়ে কেন্দ্রমুখী হয়নি। আর কেন্দ্রে ঢুকতে পারলেও নিজের পছন্দে ভোট দিতে পারেননি।’

আরও ভোটের প্রত্যাশা ছিল আকতারুজ্জামানের

২০১৫ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘লাউ’ প্রতীক নিয়ে লড়েছিলেন আকতারুজ্জামান। ওই নির্বাচনে তিনি পান ৩৬২ ভোট। এবার বাংলাদেশ কংগ্রেস থেকে ‘ডাব’ প্রতীক নিয়ে লড়েছেন তিনি। পেয়েছেন ২ হাজার ৪২১ ভোট।

আকতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আম ও ডাব দুটি প্রতীক কাছাকাছি হয়ে যাওয়ায় ভোট কিছুটা কমেছে। ভোটারদের উপস্থিতি হতাশাজনক। ঘরে বসে শুধু রিমোট টিপলেই হবে না। খাব–দাব, ঘুমাও, প্রতিবাদ করব না, তাহলে হবে না। জনগণের দায়িত্ববোধ থাকতে হবে।’

আনিসুরের শঙ্কা সত্যি হয়েছে

২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরের উপনির্বাচনে এনপিপির প্রার্থী আনিসুর রহমান দেওয়ান পেয়েছিলেন ৮ হাজার ৬৯৫ ভোট। এবার আম প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৫৩ ভোট। নির্বাচনের আগেই তিনি ‘হেভি ওয়েট’ প্রার্থীর ভিড়ে ভোট কমে যাওয়ার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

আনিসুর রহমান দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের দিন যে পরিস্থিতি ছিল, আমার অনেক কাছের লোকজন ভোট দিতে পারেননি। এমনকি আমাকেও ভোট দিতে গিয়ে কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি এত কম হবে, এটা একেবারেই কাম্য ছিল না।’

সিপিবির ভোট বেড়েছে ৬ গুণ

২০১৫ সালে ঢাকা উত্তরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রার্থী ছিলেন আবদুল্লাহ আল ক্বাফী। তিনি পেয়েছিলেন ২ হাজার ৪৭৫ ভোট। এবার ঢাকা উত্তরে সিপিবি মনোনীত প্রার্থী আহাম্মদ সাজেদুল হক পেয়েছেন ১৫ হাজার ২১১ ভোট। যা আগের তুলনায় ৬ গুণের বেশি।

 আহাম্মদ সাজেদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন এমন কোনো পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি, যাতে জনগণ ভোট দিতে আসবে। দ্বিদলীয় রাজনীতি পছন্দ করেন না, এমন অনেক ভোটারই আসেননি। অনেক কেন্দ্রে ভোটারদের পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি।’ অবশ্য তিনি বলেন, এর চেয়ে বেশি ভোট পাবেন—এমন প্রত্যাশা ছিল তাঁর।

৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি দাবি শাহীনের

ঢাকা উত্তরে ‘বাঘ’ প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে লড়েছেন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির নেতা শাহীন খান। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদে উপনির্বাচন হয়। ওই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। মেয়র পদে লড়েন পাঁচজন। উপনির্বাচনে শাহীন খান পেয়েছিলেন ৮ হাজার ৫৬০ ভোট। এবারের নির্বাচনে পেয়েছেন ২ হাজার ১১১ ভোট।