পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়া হচ্ছে না

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

আজ ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। বলা হয়ে থাকে, যে জাতির বই পড়ার অভ্যাস যত বেশি, সে জাতি তত বেশি উন্নত। কিন্তু দেশে পাঠাভ্যাস এতই কমে গেছে যে উপহার হিসেবে এখন বই দেওয়ার চল দেখা যায় না বললেই চলে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার মতো পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানগুলোতে বইয়ের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে থালা-বাটি-গ্লাসের মতো ক্রোকারিসামগ্রী।

মানুষের পাঠাভ্যাস বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো দিবসটি উদ্‌যাপন করা হয়।

সহ–শিক্ষা কার্যক্রমের পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত বই বা শিক্ষাসহায়ক উপকরণ দেওয়ার দাবি ছিল অনেক দিন ধরেই। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে গত বছর নির্দেশও দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। শিক্ষার্থীদের বইমুখী করার লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ নিয়েছিল অধিদপ্তর। কিন্তু সে নির্দেশ কাগজে–কলমেই থেকে গেছে।

সাধারণত প্রতিবছর জানুয়ারির শুরু থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শুরু হয় বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার মৌসুম। এসব অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকছেন সংসদ সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষা কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাঁদের হাত দিয়েই শিক্ষার্থীদের হাতে পুরস্কার হিসেবে উঠছে সিরামিকের থালা-বাটির মতো ক্রোকারিসামগ্রী। অথচ ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের কাছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পাঠানো আদেশে বলা হয়েছিল, সহ–শিক্ষা কার্যক্রমের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রতিযোগীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে ক্রোকারিসামগ্রী দেওয়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গুণগত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে সব অনুষ্ঠানে প্রতিযোগী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে বয়সোপযোগী মানসম্মত বই বা শিক্ষাসহায়ক উপকরণ দিতে হবে।

১ ফেব্রুয়ারি ছিল মাগুরা আদর্শ কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া সাংস্কৃতিক ও নবীনবরণ অনুষ্ঠান। একই দিনে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়েছে মাগুরা সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসায়। দুটি অনুষ্ঠানেই প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সাংসদ। অনুষ্ঠানে আরও অতিথি ছিলেন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। দুই অনুষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের হাতে পুরস্কার হিসেবে তুলে দেওয়া হয়েছেক্রোকারিসামগ্রী।

জানতে চাইলে মাগুরা আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ সূর্যকান্ত বিশ্বাস গত শনিবার জানান, তাঁরা পুরস্কার হিসেবে প্রথমে বই দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পরে ক্রোকারিসামগ্রী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষকেরা। তবে পুরস্কার পাওয়া শিক্ষার্থীরা অবশ্য উল্টোটাই জানিয়েছে। ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিসেবে সিরামিকের একটি করে থালা পুরস্কার পায় অনীক হোসেন ও রাজু আহম্মেদ। প্রথম আলোকে তারা দুজন বলে, প্লেটের জায়গায় বই হলেই বরং ভালো হতো। অনুষ্ঠানে মার্বেল দৌড়ে পুরস্কার পাওয়া একাদশ শ্রেণির ছাত্রী তানজিম রহমান বলে, যে থালা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছে, তা প্রায় সবার ঘরে আছে। ফলে এই পুরস্কারের কোনো বিশেষত্ব নেই। এর জায়গায় একটি বই পেলে সেটি অনেক দিন যেমন সংরক্ষণ করা যেত, তেমনই ওই বই বাড়ির অন্য সদস্যরাও পড়ার সুযোগ পেত।

গত ২৭-২৮ ডিসেম্বর ছিল মাগুরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। সেখানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ৪৫০টিরও বেশি পুরস্কার দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। সেখানেও দেওয়া হয়েছে ক্রোকারিসামগ্রী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,প্রতিটি পুরস্কারের মূল্য ছিল ৬০-১২৫ টাকা। জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জিয়াউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছরের অন্যান্য প্রতিযোগিতায় আমরা পুরস্কার হিসেবে বই দিয়ে থাকি। কেবল এই অনুষ্ঠানেই ক্রোকারিসামগ্রী দেওয়া হয়। এখানে আমাদের কিছু ব্যর্থতা অবশ্যই আছে।’

একইভাবে গত সপ্তাহে মাগুরা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়, মহম্মদপুরের কাজী সালিমা হক মহিলা ডিগ্রি কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে শিক্ষার্থীদের হাতে গেছে শত শত সিরামিকের প্লেট-গ্লাস।

শিক্ষকেরা জানান, পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়াকে ঝামেলা মনে করেন অনেকে। কারণ কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি ১০০টি পুরস্কার থাকে, তাহলে এই আলাদা ১০০টি বই খুঁজে দামের সঙ্গে মেলানো জটিল একটি কাজ। তা ছাড়া পুরস্কারের যে বাজেট থাকে, তার মধ্যে মানসম্মত বই মেলানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

মাগুরা শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলায় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসা মিলিয়ে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৩০০টি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর মধ্যে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই পুরস্কার হিসেবে বই বা শিক্ষাসামগ্রীদেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রণজিৎ কুমার মজুমদার গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি জানিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তারপরও নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।

একই অবস্থা প্রাথমিকেও। জেলায় মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৫০৩টি। সেখানেও পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়ার রীতি নেই বললেই চলে। জেলাপ্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকুমারেশ চন্দ্র গাছি বলেন, ‘শিশুদের বই দিতে পারলে তো খুবই ভালো হয়। উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে যেসব প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে আমরা বই দিয়ে থাকি। কিন্তু স্কুল পর্যায়ে তা সম্ভব হয় না। কারণ প্রতিটি স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বরাদ্দ দুই হাজার টাকারও কম। এই সীমিত অর্থে মানসম্মত বই কেনা প্রায় অসম্ভব। ফলে এ বিষয়ে আমরা শিক্ষকদের চাপ দিতে পারি না।’