দেশে একের পর এক নতুন রোগ

নতুন রোগের সংক্রমণ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোনো কিছু রোগ আবার নতুন করেও দেখা দিচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ রকম ১৮টি নতুন রোগে বাংলাদেশের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতি তিন বছর অন্তর গড়ে একটি করে নতুন রোগ বাংলাদেশে ঢুকছে।

সম্প্রতি চীনে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর এ নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। অতীতেও সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, মার্স করোনাভাইরাস, সার্স করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছিল। কারণ, শুরুতে এসব রোগের গতি-প্রকৃতি মানুষের জানা ছিল না। একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রেও।

গত ২৮-৩০ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৫ তম ডায়রিয়াজনিত রোগ ও অপুষ্টিবিষয়ক এশীয় সম্মেলনের একটি অধিবেশনে সংক্রামক রোগের একটি তালিকা উপস্থাপন করা হয়। ১৯৭০ সালের পর থেকে বিশ্বে শনাক্ত হওয়া নতুন এসব সংক্রামক রোগের তালিকা তৈরি করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারিবিষয়ক পর্যালোচনা কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান। এর পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়া নতুন রোগের পৃথক একটি তালিকাও তৈরি করেছেন। তিনি ২০১২ সালে সৌদি আরবে প্রথম মার্স করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন।

অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কিছু রোগ একেবারেই নতুন যেমন নিপাহ, এইচআইভি, বার্ড ফ্লু ইত্যাদি। আবার কিছু রোগ বহুদিন অনুপস্থিত ছিল, আবার নতুন করে তা হাজির হচ্ছে। যেমন এনথ্রাক্স।

ওই তালিকা অনুসারে স্বাধীনতার পর দেশে ১৮টি নতুন রোগ শনাক্ত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে এ দেশের মানুষ প্রথম ‘জাপানিজ এনকেফালাইটস’ নামের রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগের বাহক মশা। তালিকায় সব শেষে আছে ‘ক্যানডিডা আউরুস’ নামের ছত্রাক। এই ছত্রাক ওষুধ প্রতিরোধী। সাধারণত বিভিন্ন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রোগীরা এতে আক্রান্ত হচ্ছে। এইচআইভি/এইডস, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, নিপাহ, জিকা—এসব রোগ অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে। এদের নাম বেশি শোনা যায়। কিন্তু আরও কিছু রোগের নাম তালিকায় আছে যেগুলো নিয়ে আলোচনা বা জানাজানি কম হয়েছে। যেমন ২০১৩ সালে শনাক্ত হওয়া নোরো ভাইরাস বা ২০০০ সালে লেপটোসিরোসিস নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। প্রথমটি পাখির মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়টি ইঁদুরের প্রস্রাবের মাধ্যমে ছড়ায়।

>১৯৭০ সালের পর বৈশ্বিকভাবে আলোচিত নতুন রোগ ৩২ টি
এর মধ্যে ১৮টি রোগ শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশে

সারা বিশ্বেই নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটছে। দেখা যাচ্ছে, যা ছিল প্রাণীর রোগ, তাতে এখন আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। যেমন সোয়াইন ফ্লু। মূলত শূকরের রোগ। কিন্তু এখন মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন হয়ে নতুন ভাইরাস হয়। কিছু ভাইরাস অন্য প্রাণীর মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু মানুষের সংস্পর্শে এলে তা প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। যেমন নিপাহ ভাইরাস। এই ভাইরাস বাদুড় বহন করে। কিন্তু বাদুড় থেকে মানুষে এলেই সমস্যা তৈরি করে।

এ রকম কত রোগ প্রাণী থেকে মানুষে আসছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এখন থেকে ১০ বছর আগে ঢাকার একটি সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি-আটলান্টা) সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথের সহকারী পরিচালক পিটার বি ব্লোল্যান্ড তাঁর উপস্থাপনায় বলেছিলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৪০০ জীবাণু দ্বারা মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে। এসব জীবাণুর ৬১ শতাংশের উৎস প্রাণিজগৎ। ১৯৮০ সাল থেকে (২০১০ সাল পর্যন্ত) মানুষ ৮৭টি নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

১৯৭০ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যাপক মাহমুদুর রহমানের করা তালিকায় বৈশ্বিকভাবে আলোচিত ৩২টি নতুন রোগের উল্লেখ আছে।

গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে সংক্রামক রোগের বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। মার্স, সার্চসহ বেশ কয়েক ধরনের করোনাভাইরাস আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন করোনাভাইরাসটির নাম দিয়েছে নভেল ‘২০১৯-এনসিওভি’। এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে মারা গেছে ৬৩৬ জন। শুধু বৃহস্পতিবারই ৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চীনে আক্রান্তের সংখ্যা ৩১ হাজার ছাড়িয়েছে। চীনের বাইরে ২৭টি দেশ ও অঞ্চলে আক্রান্ত হয়েছে ৩২০ জন। মারা গেছে ২ জন। এখন পর্যন্ত রোগটির কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি।

মাহমুদুর রহমানের তৈরি করা বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের তালিকা পাশাপাশি রাখলে দেখা যায়, আমেরিকা, আফ্রিকা বা ইউরোপের কোনো দেশে দেখা দেওয়া নতুন রোগ কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে চলে আসে। কখনো সময় নেয় বেশি, কখনো কম। যেমন এইচআইভি/এইডস আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৮০ সালে। বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। নিপাহ প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, মালয়েশিয়ায়। এর তিন বছরের মাথায় ২০০১ সালে তা বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছিল।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও পশুস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মানুষ যত বেশি পশুপাখির কাছাকাছি অবস্থান নিচ্ছে, তত বেশি রোগ ছড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নীতিশ দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি কারণে এমনটি হচ্ছে। বন ধ্বংসের কারণে মানুষের কাছাকাছি আসছে বন্য প্রাণী। দ্বিতীয়ত নিবিড় কৃষি চর্চার কারণে রোগ প্রাণী থেকে মানুষে আসছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের কারণে মানুষ অতি অল্প সময়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছে। সঙ্গে যাচ্ছে রোগ। চলমান নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তার উদাহরণ।

বাংলাদেশে রোগের প্রাদুর্ভাবের ওপর নজর রাখে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা ঘটনার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে থাকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুসরণ করে প্রতিরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সর্বস্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সাধারণ মানুষকে সচেতন করার কাজও চলে। রোগ শনাক্ত করা, আক্রান্ত মানুষকে পৃথক রাখাসহ সব কাজ করা হয় আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে। ঠিক এখন যেমন করা হচ্ছে। আবার নতুন রোগী শনাক্ত হলে তার চিকিৎসাও হয় সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসরণ করে।’