স্থলবন্দরগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় হ-য-ব-র-ল

আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে আছে থার্মাল স্ক্যানার মেশিনটি। শুধু থার্মোমিটার ও  স্টেথোস্কোপ দিয়ে চলছে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা, বেনাপোল, যশোর,৭ ফেব্রুয়ারি।  ছবি: এহসান-উদ-দৌলা
আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে আছে থার্মাল স্ক্যানার মেশিনটি। শুধু থার্মোমিটার ও স্টেথোস্কোপ দিয়ে চলছে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা, বেনাপোল, যশোর,৭ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

চীন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী ভারতের কেরালা রাজ্যেও তিন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে গত মাসে দেশের সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও চেকপোস্টে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে সরকার। তবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোলের থার্মাল স্ক্যানারটি অকেজো। সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরের স্ক্যানারটিও অকেজো। আবার কোথাও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ঢিলেঢালাভাব, কোথাও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজেদের সুরক্ষার ঘাটতি রয়েছে। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বেশির ভাগ স্থলবন্দরে নেওয়া পদক্ষেপের মধ্যে হ–য–ব–র–ল পরিস্থিতি দেখা গেছে।

প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা দেশের আটটি স্থলবন্দর ও চেকপোস্টে গিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পেয়েছেন। তবে সব কটি বন্দর কর্তৃপক্ষই দাবি করেছে, তারা তৎপর হওয়ার পর গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত কোনো বন্দরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি। ত ছাড়া শুরু থেকে সরকার বলে আসছে, সব বন্দরেই স্বাস্থ্য পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় যেকোনো ধরনের গাফিলতি দেশের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। দেশে আসা প্রত্যেক যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা যথাযথ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্র বলেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ১৮ জানুয়ারি এই বন্দরে আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্কতা জারি করা হয়। ওই দিন বিকেল থেকেই এই বন্দরে ভারত থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে আসা ৩০ হাজার ১৯৬ জনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক ৬ হাজার ৪৮ জন, অন্য দেশের নাগরিক ২০৬ জন। বাকিরা বাংলাদেশি। তবে এই বন্দরের থার্মাল স্ক্যানার যন্ত্রের মনিটরটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। ফলে দুটি ম্যানুয়াল হ্যান্ড থার্মাল দিয়েই যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। এ ছাড়া ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে স্থলবন্দরের বাইপাস সড়কে পণ্যবাহী ট্রাক থামিয়ে ভারত থেকে আসা ট্রাকচালক ও তাঁদের সহকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।

যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনিটরটি মেরামতের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এই মনিটর মেরামতের কারিগর বাংলাদেশে নেই। যে কারণে তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করা যাচ্ছে না বলে আমাদের জানানো হয়েছে।’

সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরেও ডিজিটাল থার্মোমিটারই ভরসা। ফলে তৈরি হচ্ছে যাত্রীদের লম্বা সারি। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বন্দরে একজন স্বাস্থ্যকর্মী যাত্রীর কপালে থার্মোমিটার ঠেকিয়ে তাপমাত্রা মাপছেন। একজন সচেতনতামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। অন্য একজন পাসপোর্ট থেকে যাত্রীদের নাম–ঠিকানা লিখে রাখছেন। তাঁদের মুখে মাস্ক থাকলেও হাতে গ্লাভস নেই। এ বিষয়ে ভোমরা স্থলবন্দর করোনাভাইরাস স্বাস্থ্য ইউনিটে কর্মরত স্যানিটারি পরিদর্শক মো. সোবহান বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা গ্লাভস পরেন, তবে ওই সময় পরেননি। এই বন্দরে ডিজিটাল থার্মোমিটার ছাড়া অন্য কোনো যন্ত্রপাতি নেই। রয়েছে লোকবলসংকটও।

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন হুসাইন সাফায়েত বলেন, লোকবলসংকটের কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। একটা থার্মাল স্ক্যানার দেওয়া হয়েছিল, সেটি কাজ করছে না। একটি ডিজিটাল থার্মোমিটার দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। ঢাকা থেকে আরও একটি ডিজিটাল থার্মোমিটার পাঠানো হচ্ছে।

কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রাই মাপা হচ্ছে না। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের উপসর্গসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশ্ন করেই সন্তুষ্ট হচ্ছে মেডিকেল টিম।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা। শূন্যরেখার ওই পারে ভারতীয় অংশে মেডিকেল টিম কাজ করছে। মাস্ক, গ্লাভস পরে থার্মাল স্ক্যানারে ভারতে ঢোকা যাত্রীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে তারা। আর এপারে বাংলাদেশ অংশে খোলা আকাশের নিচে একজন স্বাস্থ্যকর্মী কেবল ডিজিটাল থার্মোমিটারে কাজ সারছেন। তাঁর মাস্ক থাকলেও গ্লাভস নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে মেডিকেল ডেস্ক বসানোর ১৩ দিনেও থার্মাল স্ক্যানার পৌঁছায়নি। আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার ফোরকান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিজিটাল থার্মোমিটারটি বৃহস্পতিবার দুপুরে আমাদের কাছে পৌঁছেছে।’

চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন এ এস এম মারুফ হাসানের দাবি, দর্শনা চেকপোস্টে দায়িত্বরত চিকিৎসা দলের প্রয়োজনীয় জনবল ও মানসম্পন্ন রোগনির্ণয় সরঞ্জাম রয়েছে। তবে গতকাল সেখানে গিয়ে এই চেকপোস্টের চিকিৎসা দলের নেতৃত্বে থাকা দুজন চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁদের একজন উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা (স্যাকমো) ওয়াশীম আলী বলেন, তিন দিন ধরে থার্মাল হ্যান্ড স্ক্যানার ও স্টেথোস্কোপ দিয়ে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। এই তিনজনের মধ্যে ওয়াশীমের মাস্ক থাকলেও বাকি দুজনের গ্লাভস, মাস্ক—কোনোটাই পরা ছিল না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, গত ১২ দিনে চিকিৎসা দল দর্শনা চেকপোস্টে কাজ করলেও দুই চিকিৎসা কর্মকর্তার একজনও দিনের দ্বিতীয় ভাগে দায়িত্ব পালন করেননি। এ বিষয়ে চিকিৎসা কর্মকর্তা তানভীর মো. আসিফ মুজতবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। অপর চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. শাকিল আর সালান দাবি করেন, তাঁর সদর হাসপাতালে এবং তানভীর মো. আসিফ মুজতবার দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগে গতকাল রাতে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল। তাই চেকপোস্টে যাননি।

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরে গত সোমবার থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু করেছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। গতকাল দেখা যায়, এই বন্দরে এক চিকিৎসা কর্মকর্তার নেতৃত্বে দুজন স্বাস্থ্যকর্মী ডিজিটাল থার্মোমিটার দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন।

পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ২৮ জানুয়ারি সকাল থেকে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের একটি কক্ষে মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে। এখানে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের নিজস্ব অর্থায়নে কেনা একটি থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে গত বুধবার থেকে কাজ চলছে। তবে পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মীরাও প্রয়োজনীয় সুরক্ষামূলক পোশাক, মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করছেন না। তাঁদের ভাষ্য, এসবের সরবরাহ নেই। 

সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দরেও কোনো থার্মাল স্ক্যানার নেই। ডিজিটাল থার্মোমিটার আর যাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেই সারা হচ্ছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা। গত ২৮ জানুয়ারি এই বন্দরে ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধ মেডিকেল ক্যাম্প’ চালু হয়। গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স সুশান্ত কুমার দেব বলেন, ‘আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে করোনাভাইরাসের উপসর্গগুলোর লক্ষণ রয়েছে কি না, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করতে। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ব্যক্তিরা সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন কি না এবং তাঁদের পাসপোর্টে কোন কোন দেশে সম্প্রতি গিয়েছিলেন, সেসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, প্রতিনিধি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চুয়াডাঙ্গা, পাটগ্রাম, পঞ্চগড় এবং যশোর ও সিলেট অফিস]