'ফলপ্রসূ ও প্রাণবন্ত' সভা করলেন ডাকসুর নেতারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ফাইল ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ফাইল ছবি

গত বছরের মার্চে নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও কাদা ছোড়াছুড়িসহ নানা ঘটনায় তাঁদের সম্পর্কের তিক্ততার বিষয়টি সামনে এসেছে৷ মেয়াদের একদম শেষ দিকে এসে আজ শনিবার এক সভা শেষে দুজনই বললেন, সভাটি ‘অত্যন্ত প্রাণবন্ত’ হয়েছে। এই দুজন হলেন ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গোলাম রাব্বানী৷

আজ শনিবার বিকেল সোয়া তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ডাকসু ভবনের সভাকক্ষে ডাকসুর চতুর্থ কার্যনির্বাহী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডাকসুর সভাপতি অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। ডাকসুর বর্তমান কমিটির প্রথম কার্যনির্বাহী সভা হয় ২৩ মার্চ, এরপর ৩০ মে দ্বিতীয় ও ২৬ সেপ্টেম্বর তৃতীয় সভাটি হয়েছিল।

ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ডাকসুর ২৩ প্রতিনিধি ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ২ জনের পারস্পরিক দ্বিমতে আগের সভাগুলোর অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত হলেও আজকের সভা ও সভার পরের চিত্রটি ছিল একেবারেই ভিন্ন। আগের সভাগুলো এবং সভার বাইরে জাকসুর ভিপি ও জিএস বহুবার পরস্পরের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনসহ নানা অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু আজকের সভায় ছিল না কোনো পাল্টাপাল্টি অভিযোগ বা উত্তপ্ত বক্তব্য। সভার পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দুজনের কণ্ঠই ছিল শীতল।

আজ ডাকসুর চতুর্থ কার্যনির্বাহী সভা শেষে ভিপি নুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন বাস্তবতায় ডাকসু নির্বাচন হওয়ার পরও নানা ধরনের সমন্বয়হীনতা-প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা ছিল। তবে আজকে একটি প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে। আমি অকপটে বলছি, আজকে একটি ভালো সভা হয়েছে। এই আলোচনাটা এত দিন ওইভাবে হয়নি। জিএস গোলাম রাব্বানীও একই সুরে বলেন, আজকে অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও ফলপ্রসূ সভা হয়েছে।

নিজেদের ব্যর্থতাকে যেভাবে মূল্যায়ন করলেন নুরুল ও রাব্বানী:
ডাকসুর কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ এক বছর ৷ গত বছরের ২৩ মার্চ দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হতে আর বাকি ৪৪ দিন ৷ নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা যে ইশতেহার দিয়েছিলেন, তার অধিকাংশই রয়ে গেছে অপূর্ণ ৷ আজকের সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এর ব্যাখ্যাও দিলেন ভিপি নুরুল ও জিএস রাব্বানী।

নুরুল বললেন, ডাকসুতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রলীগের আন্তরিকতাটা সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি বলেই শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনেকাংশে পূরণ হয়নি৷ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন হিসেবে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের প্রভাব থাকায় হলে হলে প্রশাসনিকভাবে সিট দেওয়া, মিছিল-মিটিং-এ জোর করে শিক্ষার্থীদের না নেওয়া, হলের ক্যানটিনের খাবারের মান নিশ্চিত করার যেসব দাবি শিক্ষার্থীদের ছিল, ছাত্রলীগের সহযোগিতা ছাড়া সেগুলো পূরণ করা সম্ভব নয় ৷ ছাত্রলীগের অসহযোগিতার কারণেই এগুলো করা হয়ে ওঠেনি।

তবে ছাত্রলীগের অসহযোগিতার এই অভিযোগ মানতে নারাজ রাব্বানী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাত দিনের খাবার তো এক দিনে খাওয়া যায় না৷ ২৮ বছর ডাকসু বন্ধ ছিল। ২৮ বছরের সমস্যা এক বছরে সমাধান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তবে আমরা অবশ্যই বলব যে আমরা সফল। কারণ এই এক বছরে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে আমরা যে কাজগুলো করেছি, বলাই যায় যে ডাকসুর প্রতিটি সম্পাদক ও সদস্য বেস্ট অ্যাফোর্ট দিয়েছেন। ছাত্রলীগের আন্তরিকতা আছে বলেই ডাকসু সচল আছে এবং কাজ করছে। আন্তরিকতার অভাব আমাদের কখনোই ছিল না৷ সুতরাং উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপালে চলবে না। মেয়াদের যে দেড় মাস বাকি আছে, এই সময়েও অন্য সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাব৷ '

সভায় যা হলো:
ডাকসুর আজকের সভার প্রথমেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন ডাকসুর সভাপতি মো. আখতারুজ্জামানসহ উপস্থিত সবাই৷ প্রথমে জিএস সভায় ছিলেন না৷ তাঁর পক্ষে ধন্যবাদজ্ঞাপক বক্তব্য দেন এজিএস সাদ্দাম হোসেন। সাদ্দামের বক্তব্যের পর আগের সভার কার্যবিবরণী পড়ে শোনান ডাকসুর সদস্য রাকিবুল হাসান। এরপর শুরু হয় পূর্বনির্ধারিত এজেন্ডাগুলো নিয়ে আলোচনা৷

ডাকসুর বর্তমান কমিটির এ যাবৎ ব্যয়ের অডিট সম্পন্ন করার এজেন্ডা তুলে ধরেন জিএস গোলাম রাব্বানী। এই এজেন্ডার ওপর বক্তব্য দেন ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। অডিট সম্পন্ন করতে দুজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়াও সব সদস্যকে বর্তমান কমিটির প্রথম ছয় মাসের অডিটের বিষয়টি নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন উপাচার্য। পরের ছয় মাসের অডিট নিষ্পত্তি করতে পরে একটি তারিখ দেওয়া হবে বলেও জানান উপাচার্য।

এরপর অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যাবতীয় লেনদেন পরিচালনার ব্যবস্থার এজেন্ডা উপস্থাপন করেন ডাকসুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক আরিফ ইবনে আলী ৷ অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের পরিবহনসংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা তোলেন ডাকসুর ছাত্র পরিবহন সম্পাদক শামস-ঈ-নোমান। দুটি এজেন্ডাই পাস হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন তিনটি বাসের ব্যবস্থা ও নতুন একটি বাস রুট (ঢাকা থেকে কুমিল্লা বিশ্বরোড) করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানান উপাচার্য৷

সভায় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষাবিষয়ক আলোচনা উপস্থাপন করেন এজিএস সাদ্দাম হোসেন। প্রথমে ভিপি নুরুল আপত্তি জানালেও পরে তাঁর ও ডাকসুর অন্য সব প্রতিনিধির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে ডাকসু বিরোধিতা করবে। ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলোর সংস্কার ও ইতিহাস সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেন ডাকসুর স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী। এই এজেন্ডার বিষয়েও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমস্যা শনাক্ত করে তা সমাধান ও তাঁদের জন্য সুযোগ নিশ্চিতের বিষয়ে সভায় আলোচনা উপস্থাপন করেন ডাকসুর সদস্য যোশীয় সাংমা। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের পর উপাচার্য এ ব্যাপারে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন ৷ প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ডাকসুর পক্ষ থেকে নবীন বরণের আয়োজন নিয়ে কথা বলেন এজিএস সাদ্দাম হোসেন। আলোচনার পর ১ থেকে ৬ মার্চের মধ্যে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজনের ব্যাপারে ডাকসুর সবাই সিদ্ধান্ত দেন।

ক্যাম্পাসে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে করণীয় এবং ভ্রাম্যমাণ দোকান নির্দিষ্টকরণের নীতিমালা নিয়ে সভায় আলোচনা তোলেন ডাকসুর সদস্য মুহা. মাহমুদুল হাসান। এই দুটি বিষয়েই আলোচনার ভিত্তিতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে উন্নয়ন ফি-এর নীতিমালা তৈরি নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেন ডাকসুর সদস্য তানভীর হাসান। শিগগিরই এই নীতিমালা তৈরি হবে বলে ডাকসুকে আশ্বস্ত করেন উপাচার্য। তানভীর আবাসিক হলগুলোর গণরুমে বাংক বেড স্থাপনের দাবি জানালে সভায় উপাচার্য জানান, শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি হলের গণরুমে পরীক্ষামূলকভাবে বাংক বেড স্থাপন করা হবে৷

সবশেষে হলগুলোতে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় সিট বণ্টন নিশ্চিত করার দাবি তোলেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক। এ বিষয়েও ডাকসুকে আশ্বস্ত করেন উপাচার্য ও ডাকসুর সভাপতি মো. আখতারুজ্জামান৷

পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে অবস্থান:
ডাকসুর বর্তমান কমিটির মেয়াদ একদম শেষ দিকে। পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে বর্তমান কমিটির অবস্থান কী—জানতে চাইলে ডাকসু জিএস গোলাম রাব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কারও দ্বিমত নেই যে নির্বাচন হতে হবে। উপাচার্য ডাকসুর পরবর্তী সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন। ভিপি নুরুল হকও যথাসময়ে নির্বাচনের বিষয়ে নিজের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন৷

জানতে চাইলে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে আলোচনা করে ডাকসুর পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।