কুমড়াবড়িতে দিনবদল

নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে চেউখালি গ্রাম। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর ও মৎস্যজীবী। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এই দুই পেশার মানুষের তেমন কাজ থাকে না। কয়েক বছর আগেও অনেকে ধারদেনা করে চলতেন। গত সোমবার সকালে গ্রামটিতে গিয়ে জীবনযাত্রার এমন গল্প শোনা গেল।

তবে এখন গ্রামের বাসিন্দাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। অনেক পরিবারেই পুরুষের পাশাপাশি নারীরা আয় করছেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। বাড়িতে নিয়েছেন পল্লী ও সৌরবিদ্যুতের সংযোগ। জানা গেল, জীবনমানের এই পরিবর্তনে অন্যতম অবদান ‘কুমড়াবড়ি’ বিক্রির বাড়তি আয়।

গ্রামের অন্তত ৩০টি পরিবারের নারীরা মাষকলাইয়ের ডাল, চালকুমড়া ও কালিজিরার মিশ্রণে কুমড়াবড়ি উৎপাদন করেন। এসব বড়ি আশপাশের এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের অন্য জেলায় বিক্রি হয়। রপ্তানি হয় বিদেশেও। প্রতি মৌসুমে এই গ্রাম থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার ৫০ হাজার কেজি কুমড়াবড়ি বেচাকেনা হয়।

নলডাঙ্গার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাকিব আল রাব্বী বলেন, চেউখালি গ্রামের নারীরা কুমড়াবড়ি উৎপাদন করে ওই গ্রামের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এ ছাড়া দেশ–বিদেশের ভোজনবিলাসীদের সুস্বাদু খাবার হিসেবেও কুমড়াবড়ির কদর বেড়েছে। এ কারণে খাদ্যপণ্যটি এলাকার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করার জন্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কারিগরদের দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা।

গ্রামটির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কৃষ্ণা খামারু নামের এক নারী গ্রামটিতে কুমড়াবড়ি তৈরির অন্যতম কারিগর হিসেবে পরিচিত। প্রথম আলোকে কৃষ্ণা জানান, গ্রামের প্রত্যেক কারিগর প্রতিদিন ১০ কেজি করে কুমড়াবড়ি উৎপাদন করেন। এ হিসাবে প্রতিদিন ওই গ্রামে ৩০০ কেজি কুমড়াবড়ি উৎপাদিত হয়। মাসে ৯ হাজার কেজি করে প্রতি মৌসুমে (৫ মাসে) উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কেজি। প্রতি কেজি ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করা হলে আর্থিক লেনদেন হয় গড়ে প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। প্রতি কেজি কুমড়াবড়ি উৎপাদনে খরচ হয় ৯০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কেজিতে লাভ প্রায় ২১০ টাকা।

কুমড়াবড়ি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে কথা হলো শেফালি রানী নামের আরেক নারীর সঙ্গে। শেফালি বলছিলেন, আগের দিন রাতে প্রথমে মাষকলাইয়ের ডাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। একই সময় ঢেঁকি বা পাটাতে কুমড়া পিষে খামির তৈরি করে তা নরম কাপড়ে শক্ত করে বেঁধে রাখতে হয়। এতে অতিরিক্ত পানি ঝরে যায়। পরদিন ভোরবেলা শিল পাটায় ডাল পিষে তা কুমড়ার খামিরের সঙ্গে মেশানোর পর আঙুলের ছোঁয়ায় ছোট ছোট বড়ি বানানো হয়। বাঁশের খিলান বা চালনার ওপর বড়িগুলো বসিয়ে চলে রোদে শুকানোর কাজ। শেফালি রানী জানান, ডাল ও কুমড়ার আনুপাতিক হার সঠিক না হলে বড়ি সুস্বাদু হয় না। এর যথাযথ অনুপাত হবে দুই কেজি মাষকলাই ডালের সঙ্গে আড়াই কেজি কুমড়া বাটা ও ৫০ গ্রাম কালিজিরা।

গ্রামের সুচিত্রা রানী ১২ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে কুমড়াবড়ি বানান। তিনি জানান, এক যুগ আগে তাঁরা ঘর–গৃহস্থালির কাজ শেষে বেকার বসে থাকতেন। টাকার প্রয়োজন হলে স্বামীর কাছে হাত পাততে হতো। এখন তাঁরা কুমড়াবড়ি বানিয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রয়োজনে স্বামীকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন।

নাটোর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহবুব হোসেন জানান, মাষকলাইয়ের ডাল, চালকুমড়া ও কালিজিরাসহ যেসব উপাদান দিয়ে কুমড়াবড়ি বানানো হয়, তার সবগুলোই পুষ্টিকর খাবার। তাই স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কুমড়াবড়ি বানালে তা রসনাবিলাসের পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদাও মেটাবে।