করোনাভাইরাস: দেশে বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার তথ্যে গরমিল

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে নতুন কন্ট্রোল রুম খুলেছে গত ২১ জানুয়ারি। এই কন্ট্রোল রুম থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরোনো হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দূরত্ব ২০০ গজের কম। কিন্তু বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়ে দুই কন্ট্রোল রুম দুই রকম তথ্য দিচ্ছে।

এদিকে সিঙ্গাপুরে একজন বাংলাদেশি নাগরিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে সেখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশন জানিয়েছে। তাঁকে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ বা এনসিআইডিতে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে।

গত ডিসেম্বরে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে চীনে। গত শনিবার এই ভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন ৮৯ জন। মৃত্যুর সংখ্যার বিবেচনায় এটি ছিল চীনের সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন। এ নিয়ে দেশটিতে ৮১১ জনের মৃত্যু হলো।

২০০২-০৩ সালে চীনে মহামারি আকারে দেখা দেওয়া সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা সার্সে ৭৭৪ জন মারা গিয়েছিল। গত শনিবার এই সংখ্যাও ছাড়িয়ে যায় নতুন করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঘটনা। ভাইরাসটি ইতিমধ্যে চীনের বাইরে ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে।

সরকারের দুই দপ্তরের তথ্যে গরমিল
নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের নাগরিকেরাও উদ্বিগ্ন। সরকারের দুই কন্ট্রোল রুম থেকে দুই রকম তথ্য পাওয়ার পর এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিমান, স্থল ও নৌবন্দরে বিদেশ থেকে আসা সব যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ঠিকমতো হচ্ছে তো?

বিমান, স্থল ও নৌবন্দরে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে প্রথম আলো একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আমাদের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন বন্দর ঘুরে দেখেছেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা যথাযথভাবে হচ্ছে না, সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই দপ্তরের তথ্যের মধ্যেও গরমিল দেখা গেল।

>

সিঙ্গাপুরে এক বাংলাদেশি আক্রান্ত। চীনে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৮১১। ২০০২-০৩ সালে সার্সে ৭৭৪ জন মারা গিয়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম দেশের সব ধরনের বন্দর এবং আইইডিসিআর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য নেয়।

 হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে গতকাল রোববার বিকেল ৪টা ৪১টি মিনিটে পাওয়া ই-মেইলে দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮ থেকে রোববার সকাল ৮টা) তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ২৮টি স্থলবন্দর ও দুটি সমুদ্রবন্দর দিয়ে মোট ১৬ হাজার ২৩ জন যাত্রী বাংলাদেশে এসেছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ২১০ জন এসেছে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। তাঁদের সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে।

অন্যদিকে আইইডিসিআরের কন্ট্রোল রুম বলছে, ২৪ ঘণ্টায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৯ হাজার ৬৭৬ জন যাত্রী বাংলাদেশে এসেছে। তাঁদের সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে। তবে দুই কন্ট্রোল রুমের যাত্রীর সংখ্যার পার্থক্য ১ হাজার ৪৬৬ জন।

ওই একই সময়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ১০৮ যাত্রী বাংলাদেশে ঢুকেছেন বলে তথ্য দিয়েছে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। আইইডিসিআরের অবশ্য এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। দুটি বন্দরেই নির্দিষ্ট স্থানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। তবে বন্দরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যাত্রীরা নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে তাঁদের সুবিধামতো স্থানে নামেন। সুতরাং সমুদ্রবন্দরে আসা সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে না।

হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের লক্ষণযুক্ত একজন যাত্রী হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শনাক্ত হয়েছে। এ রকম কোনো তথ্য আইইডিসিআরের ই-মেইলে নেই।

এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ রকম কেন হলো, তা আগামীকাল (আজ সোমবার) বলা সম্ভব হবে।’

 তথ্যের গরমিল নিয়ে জানতে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এর আগে গতকাল দুপুরে আইইডিসিআরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মীরজাদী সেব্রিনা বলেছিলেন, আগে শুধু চীন থেকে আসা উড়োজাহাজের যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছিল। গত তিন দিনে বিমানবন্দরে আসা সব দেশের উড়োজাহাজের যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে উদ্ধৃত করে মীরজাদী সেব্রিনা গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি স্থিতিশীল। তবে তুলনামূলকভাবে সিঙ্গাপুরের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। সিঙ্গাপুর ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হবে কি না, তা গভীরভাবে ভাবছে বাংলাদেশ।

এক প্রশ্নের জবাবে মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, বাংলাদেশ সবকিছু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী করছে। দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত করার প্রযুক্তি আছে। দেশে কোনো ব্যক্তি শনাক্ত হলেও তা পরীক্ষার ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত ল্যাবরেটরিতে নমুনা পাঠানো হবে। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তির নাম, পরিচয় প্রকাশ পেলে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

এদিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চীনফেরত শিক্ষার্থীর শরীরে প্রাথমিকভাবে করোনাভাইরাস আক্রান্তের লক্ষণ পায়নি চিকিৎসা বোর্ড। গতকাল ১২ সদস্যবিশিষ্ট গঠিত চিকিৎসা বোর্ডের প্রধান ও মেডিসিন বিভাগের প্রধান দেবেন্দ্র নাথ সরকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে চীনফেরত ওই শিক্ষার্থীকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত শনিবার দুপুরে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পরপরই তাঁকে মেডিকেলের করোনা ইউনিটের আইসোলেশন ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, রংপুর মেডিকেলে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় ওই শিক্ষার্থীর রক্ত, মুখের লালা, ঘামের নমুনা ঢাকায় আইইডিসিআরেগত শনিবারই পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে পরীক্ষার প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত তাঁকে মেডিকেলের আইসোলেশন ওয়ার্ডে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।

সিঙ্গাপুরে একজন বাংলাদেশি আক্রান্ত
সিঙ্গাপুরে তিনজন নতুন করে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন বাংলাদেশের এবং অন্য দুজন সিঙ্গাপুরের নাগরিক। তাঁদের কারও সম্প্রতি চীন সফরের অভিজ্ঞতা নেই। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দ্য স্ট্রেইট টাইমস গতকাল এ খবর জানিয়েছে। এ নিয়ে সিঙ্গাপুরে মোট ৪৩ জন আক্রান্ত হলেন।

সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশের এক নাগরিকের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবরটি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের এক কর্মীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আমাদের জানিয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কারণে ৩৯ বছর বয়সী ওই বাংলাদেশির পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। আশা করছি, সোমবারের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারব। এ মুহূর্তে ওই বাংলাদেশিকে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিস বা এনসিআইডিতে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। তাঁর স্বাস্থ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় যা যা করার, হাইকমিশনের পক্ষ থেকে তা করা হবে।’

দ্য স্ট্রেইট টাইমস–এর খবরে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের লক্ষণ বুঝতে পেরে বাংলাদেশের ওই কর্মী ৩ ফেব্রুয়ারি সাধারণ একটি ক্লিনিকে যান। ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যান চেঙ্গি জেনারেল হাসপাতালে। ৮ ফেব্রুয়ারি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের বিষয়টি চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করেন। পরে তাঁকে এনসিআইডিতে পাঠানো হয়।