পাঠক ফেরাতে 'নান্দনিক' উদ্যোগ

লাইব্রেরির বঙ্গবন্ধু কর্নারে বই দেখছেন দুই পাঠক। গত বুধবার বিকেলে।  ছবি: প্রথম আলো
লাইব্রেরির বঙ্গবন্ধু কর্নারে বই দেখছেন দুই পাঠক। গত বুধবার বিকেলে। ছবি: প্রথম আলো

দোতলা ভবনটার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দরজা। ভেতরে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল বিশাল কক্ষের চারপাশের দেয়ালগুলো বার্নিশ করা বাঁশ দিয়ে মোড়ানো। ছাদেও বাঁশের ছাউনি। বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি দৃষ্টিনন্দন চারটি গোলটেবিল। প্রতিটি টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারগুলোও বাঁশ ও বেতের তৈরি। কক্ষের চারপাশে সাজানো আলমারিতে সুসজ্জিত বই। টেবিলে বসে কয়েকজন পড়ছেন। কক্ষের একপাশে বঙ্গবন্ধু কর্নারটিতে নতুনত্বের ছোঁয়া। কক্ষের পাশেই রয়েছে রেস্তোরাঁ।

একই সঙ্গে কুটিরশিল্পের সাজে দৃষ্টিনন্দন ও মনোরম পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যে বই পড়া এবং খাবারের স্বাদ মিলছে মানিকগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরিতে। শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সী পাঠকের উপযোগী এই লাইব্রেরিতে রয়েছে বিভিন্ন বই। গত ১ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক লাইব্রেরি ও বঙ্গবন্ধু কর্নার উদ্বোধন করেন।

যেভাবে শুরু

১৯৬১ সালে জেলা কালেক্টরেট ভবনের উত্তর পাশে দ্বিতল ভবনের ওপরে পাবলিক লাইব্রেরিটির চিত্র কয়েক মাস আগেও ছিল অন্য রকম। অব্যবস্থাপনা, নানা সীমাবদ্ধতা ও সমস্যার কারণে পাঠকশূন্য হয়ে পড়েছিল। একদিন প্রাণহীন লাইব্রেরিটির এই চিত্র চোখে পড়ে জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌসের। তিনি নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) আলী রাজীব মাহমুদ ওরফে মিঠুনকে সংস্কারের পরামর্শ দেন। লাইব্রেরিটি কীভাবে সাজানো যায়, পাঠকদের লাইব্রেরিমুখী করা যায়, তা ভাবতে শুরু করেন রাজীব মাহমুদ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজীব মাহমুদ দেখলেন, ভেন্ডারদের চেয়ার-টেবিলে লাইব্রেরির পুরো পথ অবরুদ্ধ। ফাঁকফোকর গলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখলেন, লাইব্রেরির ভেতরে ভুতুড়ে অবস্থা। অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। পলেস্তারা খুলে পড়ছে। আলমারিগুলো ভেঙে পড়ার দশা। বইগুলোতে ধুলাবালুর আস্তর জমে আছে। আলী রাজীব ভাবলেন, লাইব্রেরির পশ্চিম পাশে চওড়া বারান্দা রয়েছে। সেখানে রেস্তোরাঁ করলে মন্দ হয় না। এতে বইপড়ার পাশাপাশি খাবারের ব্যবস্থা থাকলে পাঠক আকৃষ্ট হবেন। পাশাপাশি এ থেকে প্রাপ্ত আয়ের অর্থ লাইব্রেরি পরিচালনায় কাজে লাগানো যাবে।

শুরু হলো কর্মযজ্ঞ

রাজীব মাহমুদ জানালেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ করে লাইব্রেরির সামনে প্রবেশপথের দুই পাশে টিনের ছাউনি দিয়ে ভেন্ডারদের বসার ব্যবস্থা করেন। এ থেকে কিছু অর্থের জোগান হয়। তিনি টাঙ্গাইল ও ঢাকা ঘুরে কারিগর খুঁজতে শুরু করেন। অবশেষে ঢাকা থেকে কয়েকজন কারিগর এনে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু করলেন। চারপাশের দেয়াল, ছাদে এবং ভবনের মাঝের চারটি স্তম্ভ বার্নিশ করা বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হলো। প্রতিটি স্তম্ভের সঙ্গে গোলাকার বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি টেবিল–চেয়ার জুড়ে দেওয়া হলো। পুরোনো আলমারিগুলো সংস্কার করে নান্দনিক রূপ দেওয়া হলো।

রাজীব মাহমুদ বলেন, কাজ চলাকালে তিনি সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় বিভাগীয় কার্যালয়ে গেলেন। তবে ছুটির দিনগুলোতে তিনি মানিকগঞ্জে এসে কাজ তদারকি করেন। পাঠকদের লাইব্রেরি ঢুকতে পাশ্চিম পাশে নতুন করে স্থাপন করা হলো পেঁচানো সিঁড়ি। লাইব্রেরি ও রেস্তোরাঁয় দৃষ্টিনন্দন বৈদ্যুতিক বাল্বগুলো বসানো হলো। কাজ যখন শেষ পর্যায়ে, তখন লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু কর্নার করার পরিকল্পনা মাথায় এল। স্থাপন করা হলো কিয়স্ক যন্ত্র। এতে পাঠকদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্নারে রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বই, বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ছবি। কর্নারের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, পুরো কর্নারে লাল-সবুজের ছাপ। 

সরেজমিন একদিন

৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে পশ্চিম পাশের সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই প্রথমে চোখে পড়ে রেস্তোরাঁ। পাশের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে সুবিশাল কক্ষের ভেতর সাজানো ২৪টি আলমারিতে বইয়ের বাহার। উপন্যাস, গল্প, নাটক, বিবিধ, পাঠ্য, ইসলামি, সাহিত্য, আত্মজীবনী, ইংরেজি সাহিত্যসহ শিশুতোষ বই রয়েছে আলমারিগুলোতে। চোখে পড়ল বাঁশ ও বেতের তৈরি বিশাল বিশাল চারটি গোলাকার টেবিল। পাশের চেয়ারগুলোও বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি। দুটি টেবিলে বসে বই পড়ছেন কয়েকজন পাঠক। পাশে বঙ্গবন্ধু কর্নার ঘুরে দেখছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। 

আতিকুর রহমান নামের এক পাঠক জানালেন, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী চিন্তা থেকেই এই লাইব্রেরিকে নতুন রূপে সাজানো হয়েছে। লাইব্রেরিয়ান মহিদুর রহমান বলেন, লাইব্রেরিতে ২৪টি আলমারিতে প্রায় সাত হাজার বই রয়েছে। নান্দনিক রূপের এই লাইব্রেরিতে পাঠকের আনাগোনায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাচ্ছে। 

কলেজশিক্ষক ও লেখক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, অব্যস্থাপনা ও জরাজীর্ণ ভবনের কারণে লাইব্রেরি থেকে পাঠকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কারণে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। নতুন রূপে এটি পাঠকদের আকৃষ্ট করবে। 

জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস বলেন, বইপড়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ছোঁয়াও লেগেছে লাইব্রেরিটিতে। আছে ওয়াই–ফাই সংযোগের ব্যবস্থাও। লাইব্রেরিটিতে নতুন করে পাঁচ হাজার বই দেওয়া হবে।