ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গাইবান্ধা অংশে ১৩ বাঁক যেন মৃত্যুফাঁদ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়কের গাইবান্ধা জেলার ৩২ কিলোমিটার অংশে ১৩টি বাঁক মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বাঁক অতিক্রমের সময় প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে যানবাহন। রাতের বেলা যেমন, তেমনি দিনের বেলায়ও ঘটছে দুর্ঘটনা।

মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) একটি দল ২০১০ সালে সমীক্ষা চালিয়েছিল। দলটি ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গাইবান্ধার অংশের ১৩টি বাঁকের মধ্যে ৭টিকেঅধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে। আর পুলিশ অধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নয়টি বাঁককে। এই নয়টি বাঁকে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড। তবে সেগুলো তেমন কোনো কাজে আসছে না। প্রতিবছর দুর্ঘটনার সংখ্যার সঙ্গে হতাহতের সংখ্যাও সমানে বেড়ে চলেছে। গত ৬ বছরে মহাসড়কের এ অংশে ৫১১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৮৪ জন নিহত ও ৮৬৭ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে সবচেয়ে কম২৫টি এবং ২০১৯ সালেসর্বোচ্চ ১৭৮টি দুর্ঘটনা ঘটে।

জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের গাইবান্ধা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে মহাসড়কে বাঁক সোজাকরণের কোনো প্রকল্প নেই। তবে মহাসড়কের এই অংশে যে নয়টি বাঁক অধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ, তার মধ্যে পাঁচটি স্থানে রাস্তা প্রশস্ত করে বিভাজক নির্মাণ করা হয়েছে। অন্য চারটি বাঁকে সড়ক বিভাজক নির্মাণের কাজ অচিরেই শুরু করা হবে।

ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফাঁসিতলা থেকে সাদুল্যাপুর উপজেলার ধাপেরহাট পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ১৩টি বাঁক রয়েছে। স্থানগুলো হচ্ছে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফাঁসিতলা বাসস্ট্যান্ড, বকচর, বোয়ালিয়া, কালীতলা, চাপড়িগঞ্জ, কাটাখালী, কোমরপুর বাজার, নুনদহ (জুমারঘর), দরগা, পলাশবাড়ী উপজেলার নুনিয়াগাড়ি, পলাশবাড়ী ডাকঘর, গিরিধারীপুর ব্র্যাক মোড় ও সাদুল্যাপুর উপজেলার ধাপেরহাট বাজার।

পলাশবাড়ী উপজেলা সদরের নুনিয়াগাড়ি এলাকার ট্রাকচালক জায়দাল মিয়া বলেন, মহাসড়কের এই অংশে দুই-তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতেই বাঁক এসে যায়। তখন ধীরগতিতে গাড়ি চালানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তা ছাড়া যখন বাঁক আসে, তখন বিপরীত দিক থেকে যানবাহন আসছে কি না, তা বোঝা যায় না। ফলে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা বাঁকেই ঘটছে।

দুর্ঘটনার যত কারণ

ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়কের গাইবান্ধা অংশে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে যানবাহন। এসব দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করেছে জেলা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। তাদের মতে, অসচেতনতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বেপরোয়াভাবে আরেকটি গাড়িকে অতিক্রম করা, যাত্রী ও মালামাল বহন, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো, অদক্ষচালক দিয়ে গাড়ি চালানো—এমন সাধারণ কারণগুলো আছেই। তবে এই এলাকায় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে মহাসড়কের এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকই তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

গোবিন্দগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ব্যবস্থাপক মতিয়ার রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই প্রথমে ফায়ার সার্ভিসকে উদ্ধার অভিযান শুরু করতে হয়। তিনি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখতে পেয়েছেন, এই এলাকায় মহাসড়কের বাঁকগুলোই দুর্ঘটনার জন্য বেশি দায়ী। বিশেষ করে বাঁক এলাকায় দুটি গাড়ি বিপরীত দিকে অতিক্রম করার সময় বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেহেতু বাঁক এলাকাতেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে, তাই এই প্রবণতা কমাতে এখানেই বেশি নজর দিতে হবে। স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে এসব স্থানে মহাসড়ক সোজা করা দরকার। তা সম্ভব না হলে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিটি বাঁক এলাকায় সড়কে গতিরোধক ও সড়ক বিভাজক বসানো যেতে পারে। পাশাপাশি এসব স্থান এলেই যাতে যানবাহনের চালকেরা সতর্ক হতে পারেন, তেমন ব্যবস্থা রাখতে হবে। ততে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এমন কোনো ব্যবস্থাই এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। কয়েকটি স্থানে সাইনবোর্ড টাঙানো হলেও তা সবখানে নেই। এমন সাইনবোর্ড থাকলেও চালকেরা সতর্ক হতে পারতেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাইবান্ধা সওজের একজন প্রকৌশলী বলেন, সওজ নিজে উদ্যোগী হয়ে মহাসড়কে গতিরোধক নির্মাণ করতে পারে না। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি দরকার। কিন্তু মন্ত্রণালয় গতিরোধক নির্মাণের অনুমতি দেয় না। কারণ, গতিরোধক থাকলে সেখানে রাতে চাঁদাবাজি, ডাকাতির আশঙ্কা থাকে। ২০১২ সালে দেশব্যাপী মহাসড়কের বাঁক সোজা করার একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধার অংশের সাতটি বাঁক ভেঙে সোজা করার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।

কাজে দিচ্ছে না উদ্যোগ

মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে গাইবান্ধা জেলা পুলিশ। ২০১২ সালে তারা অধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ মোট নয়টি বাঁকে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়। এগুলো হচ্ছে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কালীতলা বাজার, উপজেলা শহরের চারমাথা, বোয়ালিয়া, কোমরপুর বাজার, বালুয়া বাজার, ফাঁসিতলা ও সাদুল্যাপুর উপজেলার ধাপেরহাট বাজার। এসব স্থানে বসানো সাইনবোর্ডগুলো বিশেষ কালি দিয়ে লেখা। রাতে যানবাহনের আলোয় সেগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তখন চালকেরা সতর্ক হতে পারেন। এ ছাড়া দুর্ঘটনা রোধে পাঁচটি বাঁকে সড়ক বিভাজক নির্মাণ করা হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কালীতলা বাজার, উপজেলা শহরের চারমাথা, বোয়ালিয়া, কোমরপুর বাজার ও বালুয়া বাজারে এই বিভাজক আছে। তারপরও দুর্ঘটনা কমছে না।

দুর্ঘটনা কমাতে হাইওয়ে পুলিশ রাতে বাঁকগুলোতে বিশেষ নজরদারি রাখছে জানিয়ে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জনসচেতনতার অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই দুর্ঘটনা রোধে যানবাহনের মালিক, চালক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা হচ্ছে। চালকদের সিটবেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানো, যাত্রার আগে যানবাহন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেওয়া, মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি না চালানো, যত্রতত্র পার্কিং না করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মহাসড়কে ব্যাটারি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলতে দেওয়া হচ্ছে না। দুর্ঘটনা রোধে এসব উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।