বঙ্গবন্ধু পালাতে পারেন না

জমিনটা দীর্ঘ। ইতিহাসের জমিন। বাংলার—বলা ভালো বাংলাদেশের—ইতিহাসের এই দীর্ঘ জমিনকে সৃজনশীল বুননে বাঙ্ময় করে তুলতে কাহিনিকার প্রথম ফোঁড় দিয়েছন ১৯৩৮ সালে। শুধু ইতিহাস নয়, কল্পনা আর ইতিহাসের নিজস্ব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণে নির্মিত হয়েছে ইতিহাস–আশ্রিত এক মহা–আখ্যান। এই আখ্যানের কেন্দ্রে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সময়ের ধারাক্রম অনুসরণ করে খ্যাতিমান লেখক আনিসুল হক তাঁর উপন্যাসধারা, এই অনন্য সৃজন অব্যাহত রেখেছেন। সময়ের সূত্র ধরে পরপর লিখেছেন চারটি উপন্যাস—যারা ভোর এনেছিল, ঊষার দুয়ারে, আলো–আঁধারের যাত্রী ও এই পথে আলো জ্বেলে । এর পরের বই লেখকের নবনির্মাণ, আমাদের আজকের আলোচ্য গ্রন্থ—এখানে থেমো না।

এ বইয়ের কালপর্ব ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১। বাঙালির অচিন্তনীয় চৈতন্যোদয়ের ইতিহাসের এই কালগণ্ডির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। এই বিস্ময়কর মানুষটির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক সর্বোপরি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অনুপুঙ্খ অপরূপ মধুরিমায়, প্রাঞ্জল ভাষ্যে বয়ান করেছেন লেখক। সেই উত্তাল রাজনৈতিক দিনগুলোতে মুজিবের অটল, অনড়, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, তাঁর পরিজন, স্বজন, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের ত্যাগ–তিতিক্ষা, দেশজুড়ে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত জনমানুষের মনোজগতের কালবৈশাখীর অপরূপ ছবি এঁকেছেন ঔপন্যাসিক। এ কাহিনি ইতিহাসসূত্রে আমরা অবগত হই। কিন্তু শিল্পীর এই সৃজন ইতিহাস-ভাষ্যের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের মনোজগতে এক অপূর্ব মায়ার ঘোর তৈরি করে।

বইয়ের ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে: এল একাত্তরের মার্চ। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। আলোচনা ভেস্তে গেল। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, সৈনিকদের বঙ্গবন্ধু আদেশ দিলেন, অস্ত্র গোলাবারুদ হাতে নাও, প্রতিরোধ গড়ো। সবাই অনুরোধ করছে, মুজিব ভাই। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। আপনি পালান। মুজিব হাসছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমি পালাব না।

এ বইতে লেখক হাজির করেছেন বাংলা রূপকথার আঙ্গিকে এক ব্যাঙ্গমা ও ব্যাঙ্গমির। এরা পাঠককে ইতিহাসের আরও গভীরে নিয়ে যেতে ত্রিকালদর্শীর মতো বয়ান করে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক: ‘ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বটগাছের পাতায় পাতায় উড়ে বেড়ায়। তারা গল্প করে। তারা বলে যে মিজানুর রহমান খান নামের একজন সাংবাদিক ২০১৩ সালে একটা বই লিখবেন, মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড।...বইয়ে মিজানুর রহমান খান বলবেন, ১৯৭২ সালে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের বিষয়ে আলোচনা করতে। ১৯৭৩ সালে গিয়েছিলেন মেজর আবদুর রশিদ।... ১৯৭৪ সালে সৈয়দ ফারুক রহমান উচ্চতম পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তার নির্দশে মুজিব সরকার উৎখাতে আমেরিকার সাহায্য চান।’

ইতিহাসের এ মুজিবময় ক্যানভাসকে নিপুণ হাতে রঙিন করে তুলেছেন খ্যাতিমান এই কাহিনিকার। অসামান্য এ নির্মাণ। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলার ১৫ নম্বর প্যাভিলিয়নে।