কেনা আর ঘোরাঘুরিতেই আনন্দ

মানবাধিকার: আসিফ নজরুল, হ্যাঁ: মোহিত কামাল, পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়: মাসরুর আরেফিন, অর্ধবৃত্ত: সাদাত হোসাইন
মানবাধিকার: আসিফ নজরুল, হ্যাঁ: মোহিত কামাল, পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়: মাসরুর আরেফিন, অর্ধবৃত্ত: সাদাত হোসাইন

বেঞ্চিতে বসে নিমগ্ন হয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর টুনটুনির বই পড়ছে আজমির মাহাদী। একটু পড়ছে আর হাসছে। দু–একবার ডেকেও ওর মনোযোগ আকর্ষণ করা গেল না। মা আয়েশা আক্তারই ছেলের হয়ে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। বাবা তানজির আলমের কোলে একেবারে ছোট আহনাফ ইউসুফ। সে কেবল বড় ভাইয়ের বইটি কেড়ে নিতে চায়। আজমিরের বিড়বিড় করে উপেন্দ্রকিশোর পড়া কিন্তু চলতেই থাকে।

ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোড থেকে আসা এই পরিবারকে দেখে মনে হলো সুখী পরিবার। প্রাণোচ্ছল বাবা–মা দেখালেন, আজমিরের জন্য আরও কেনা হয়েছে আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ নামে আরেকটি বই। এখন বিশ্রাম। আবার তাঁরা বইয়ের খোঁজে বের হবেন। আপাতত তাঁদের হাতে শিলা প্রকাশনী আর শব্দশিল্পের ব্যাগ দেখা গেল।

অদূরেই প্রথমা প্রকাশন। সেখানে আসিফ নজরুলের দুটি বই বেশ বিক্রি হচ্ছে—উপন্যাস ঘোর, ও প্রবন্ধের বই মানবাধিকার। দ্বিতীয়
বইটির প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়েছে, দ্বিতীয় মুদ্রণের কাজ চলছে। আজ নতুন তিনটি বই এসেছে। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জমিনে ফারাক নেই, টোকন ঠাকুরের বুদবুদ পর্যায়ের কবিতা ও কাজী এনায়েত উল্লাহর ভালোবাসার রূপান্তর। আখতার হুসেন সংকলিত ও সম্পাদিত ছোটদের বই ঈশপের গল্প ভালো বিক্রি হচ্ছে।

মেলায় দেখা হলো সুব্রত শংকর ধরের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এই শিক্ষকের বর্তমান ঠিকানা ওয়াশিংটন ডিসি। গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশনের কান্ট্রি লিড হিসেবে কাজ করছেন সেখানে। প্রতিবছর মেলার সময় দেশে আসার চেষ্টা করেন। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেন আর ফেরার সময় সু্যটকেস–ভর্তি বই নিয়ে ফেরেন যুক্তরাষ্ট্রে। আজ বই দেখছেন। মনের মতো বই পেলে কিনে ফেলবেন।

পাঁচ–ছয় তরুণীকে দেখা গেল ছবি তুলছেন ‘বঙ্গবন্ধু পাঠ’ নামে বাঁশের তৈরি একটা ঘরের সামনে। সত্যিই দৃষ্টিনন্দন জায়গাটি। তাঁদের কথাবার্তা ছিল এমন—

‘আর তিনটা জায়গায় ছবি তুলে ফিরে যাব। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’

‘আজ তাহলে বই কিনব না?’

‘না। আজ বই কিনে ফেললে আর মেলায় আসতে দেবে না!’

মেলায় আরেকবার আসার নিশ্চয়তার জন্য দলটি এই মঙ্গলবার কোনো বই কিনবে না।

ছিমছাম বইমেলায় বই কেনা আর ঘোরাঘুরি মিলেই আনন্দ যেন পূর্ণ হয়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। এখানেও নিরাপত্তা তল্লাশি। ঢোকার মুখেই মুক্তধারা। বড় বড় করে স্টলের গায়ে লেখা আছে ‘প্রতিষ্ঠাতা: চিত্তরঞ্জন সাহা’, ‘প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭১’। এ কথা অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, চিত্তরঞ্জন সাহার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল এই বইমেলা। ১৯৭২ সালে ভাষাশহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমিতে সাত দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয়েছিল। তখন একাডেমির সামনের আমগাছের নিচে চট বিছিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহা নিজের প্রকাশনার বই দিয়ে অঘোষিত বইমেলার সূচনা করেন। এই স্টলের মোহাম্মদ সুজন জানালেন, মুক্তধারা এবার নতুন বই এনেছে শেখ মুজিবুর রহমান: বাংলাদেশ মাই বাংলাদেশ। এটা রামেন্দু মজুমদারের সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের সংকলন। ইংরেজিতে অনূদিত। পুরোনো বইয়ের মধ্যে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের যে গল্পের শেষ নেই আর সত্যেন সেনের উপন্যাস সেয়ানা বিক্রি হচ্ছে বেশি। বিক্রি হচ্ছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন

বের হওয়ার মুখে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের এখানে রয়েছে বই। দুই হাতের আঙুল দিয়ে কাগজের গর্তগুলো স্পর্শ করে বইয়ের স্বাদ নিতে পারছেন পলিন খান। তিনি পড়ছিলেন ফয়েজ আহমেদের স্কুল জোকস। তাঁর পাশেই তামান্না পড়ছেন আশিক মুস্তাফার লেখা একাত্তরের বিচ্ছু বাহিনী। তামান্না জানালেন, ছোটবেলা থেকেই ব্রেইলে পড়ছেন বলে পড়তে অসুবিধা হয় না। তবে আক্ষেপ করে বললেন, ‘সারা বছরে এক বইমেলা ছাড়া নতুন বই পড়ার কোনো সুযোগ নেই। আরও বই থাকলে এবং সারা বছর পড়ার সুযোগ থাকলে তৃপ্তি পাওয়া যেত।’ স্টলের রিয়া আখতার বললেন, ‘সব প্রকাশনী যদি অন্তত একটা করে ব্রেইলে বই করত, তাহলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পড়তে পারত।’

তাঁর পাশে বসা দৃষ্টিহীন তৃষ্ণা বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা পড়তে পারতাম!’

গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ১৫২টি। এবারের মেলায় বেঙ্গল পাবলিকেশনস এনেছে পিয়াস মজিদের এক পৃথিবী বইয়ের বাড়ি। বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে মোহিত কামালের হ্যাঁ। পাঠকসমাবেশ এনেছে মাসরুর আরেফিনের পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়। অন্যধারা এনেছে সাদাত হোসাইনের অর্ধবৃত্ত