নেত্রকোনায় স্টিয়ারিং হাতে শিশু-কিশোর

শিশু-কিশোরদের হাতে লরির স্টিয়ারিং। সম্প্রতি নেত্রকোনো সদর উপজেলার বিশিউড়া বাজারে।  ছবি: প্রথম আলো
শিশু-কিশোরদের হাতে লরির স্টিয়ারিং। সম্প্রতি নেত্রকোনো সদর উপজেলার বিশিউড়া বাজারে। ছবি: প্রথম আলো

নেত্রকোনা জেলার ১০ উপজেলাতেই গ্রামীণ জনপদে মানুষের এখন যাতায়াত ও মালামাল বহনের ক্ষেত্রে প্রধান ভরসা অবৈধ ইজিবাইক ও লরি। স্বাভাবিকভাবেই খুব ঝুঁকিপূর্ণ এসব যান। তার ওপর শিশু-কিশোরেরা আনাড়ি হাতে ইজিবাইক ও লরির স্টিয়ারিং ধরায় ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে মানুষকে চলাচল করতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ঘটছে দুর্ঘটনা।

স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেত্রকোনা জেলায় ২০০৮ সালের দিকে প্রথম ইজিবাইক চলাচল শুরু হয়। অবশ্য তখন জেলা শহরে হাতে গোনা ২০ থেকে ২৫টি এ ধরনের তিন চাকার যান ছিল। এখন তা বেড়ে গোটা জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজার ইজিবাইক ও লরি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জেলার সর্বত্র।

কৃষিকাজে ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত বড় কলের লাঙলের ইঞ্জিনটি খুলে তা লরি নাম দিয়ে ইট, বালু, মাটি, পাথর, রড, সিমেন্টসহ মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিন চাকার এই বাহনে নেই কোনো তাৎক্ষণিক গতিরোধক নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ও সতর্কসংকেত। তারপরও সময় বাঁচাতে লোকজন ঝুঁকি নিয়ে এই যান ব্যবহার করছে। সারা জেলায় বিভিন্ন সড়কে তিন সহস্রাধিক লরি চলাচল করে। আর আগে যাঁরা রিকশা বা এ ধরনের হালকা যান চালাতেন, তাঁরাই এখন ইজিবাইকের স্টিয়ারিং হাতে।

লরিগুলোর মালিক বিভিন্ন ইটভাটা, বালু-পাথর-মাটির ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, শ্রমিকনেতা ও গ্রাম্য মাতবরেরা। তাঁদেরই একটি অংশ শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। মাত্র চার থেকে সাত দিন প্রশিক্ষণ দিয়েই শিশু-কিশোরদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় গাড়ির স্টিয়ারিং। এভাবে জেলায় দিন দিন শিশু-কিশোর ইজিবাইক ও লরিচালকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এতে একদিকে যেমন শিশুশ্রম বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে দুর্ঘটনা।

শিশুদের হাতে লরি চালানোর ভার দেওয়ার বিষয়ে সদর উপজেলার চালক ইসলাম উদ্দিনের (৩৫) দাবি, ‘চালানোর ভার তাদের (শিশুদের) ওপর দিতে পারলে চালকদের অবসর সময়ে লরিটি আর বন্ধ থাকবে না। এতে মানুষেরই উপকার হবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি লরির মালিক বলেন, ‘কিশোরদের দিয়ে লরি চালানো ঠিক না, এটা আমরাও বুঝি; কিন্তু মালামাল পরিবহনের কাজের চাপ বেশি থাকলে মূল চালকেরা সব সময় গাড়ি চালাতে পারেন না। তাঁদের বিশ্রাম নিতে হয়। তাই মাঝেমধ্যে এ সময়ে তাঁদের অনেকের সন্তানেরা লরি চালায়। তবে বেশি দূরে যেতে নিষেধ করে দেওয়া হয়।’

সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার বিভিন্ন সড়কে গাদাগাদি করে মানুষ তুলে আনাড়ি হাতে কিশোরেরা ইজিবাইক চালাচ্ছে। তাদের অনেকেরই বয়স ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। অন্য যানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা এ যান চালায়। এ ছাড়া বিপজ্জনক লরির স্টিয়ারিংও শিশুদের হাতে।

গত রোববার দুপুরে সদর উপজেলার বিশিউড়া বাজারে আরিফ মিয়া নামের ১২ বছরের এক শিশুকে বালুভর্তি লরি চালাতে দেখা গেছে। লরিতে তার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে হাসেম ও সুমন নামের আরও দুই শিশু ছিল। তাদের বাড়ি দক্ষিণ বিশিউড়া এলাকায়। লরিটি থামিয়ে তাদের কাছে এই বয়সে লরি চালানোর কারণ জানতে চাইলে শিশুদের জবাব, ‘কাম না করলে খাইয়াম কী, সংসার কেমনে চলব?’ লেখাপড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানায়, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর পড়েনি। লরিটির মালিকের পরিচয় জানতে চাইলে শিশুরা জবাব না দিয়ে চলে যায়।

বিশিউড়া বাজারের ব্যবসায়ী রফিক মিয়া বলেন, এই বাজারের পথ দিয়ে শিশু-কিশোরেরা হরদম ইজিবাইক ও লরি চালায়। এভাবে তাদের দিয়ে
ঝুঁকিপূর্ণ যানগুলো চালানো ঠিক না। প্রশাসনের নজরদারি প্রয়োজন।

সদরের আধপুর গ্রামের আনিছুর রহমান বলেন, লরি বাহনটি খুবই বিপজ্জনক, এটা পরিবেশবান্ধব নয়। এর প্রচণ্ড শব্দে লোকজন অতিষ্ঠ থাকে। চলার পথে উল্টে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া এটি চলাচলের কারণে গ্রামীণ রাস্তাঘাট দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লরি চলে দুর্গাপুর উপজেলায়, বিশেষত সোমেশ্বরী নদীর বালু ভর্তি করে বিভিন্ন স্থানে বহন করার এটি সহজ মাধ্যম। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাপুরে বালু ভর্তি লরির চাপায় দুর্ঘটনায় গত এক বছরে অন্তত আটজন মারা গেছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ২০ জন।

দুর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, লরি নিষিদ্ধ যান। চালক বড় হোক আর ছোট হোক, লরি চলাচলে প্রশাসনের কোনো অনুমতি নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা নদী থেকে বালু বোঝাই করে লরিতে বহন করে নিয়ে যান। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।

ওসি বলেন, ‘এখন আমরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্কুল-কলেজ চলাকালে লরি চলাচল করতে দিচ্ছি না।’

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম ও পুলিশ সুপার মো. আকবর আলী মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, মাত্রাতিরিক্ত ইজিবাইকগুলোকে একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর শিশু-কিশোরেরা যেন ইজিবাইক চালাতে না পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অবৈধ ও বিপজ্জনক লরি চলাচল বন্ধ করে দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।