ঢাকায় নারীর আবাসনে খরচ, হয়রানি, দুই-ই বেশি

সিলেটে শিক্ষাসফরে গিয়েছিলেন এক ছাত্রী। যানজটের কারণে ঢাকায় ফিরতে মধ্যরাত। ‘সান্ধ্য আইনের’ দোহাই দিয়ে কিছুতেই ফটক খোলেননি মেসের ব্যবস্থাপক। ঢাকায় আত্মীয়স্বজন নেই, মেয়েটি রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে বাড়ির এক ভাড়াটের হস্তক্ষেপে মেসে ঢুকতে পারেন।

কথাগুলো বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ওই ছাত্রী। প্রথম আলোকে বললেন, ‘সেদিন রাতে কী করব, কোথায় যাব ভেবে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। ঢাকায় যার বাসা নেই, সে-ই কেবল থাকার কষ্ট জানে।’ এ যাবৎ তাঁকে তিনবার ঠাঁই নড়াতে হয়েছে।

বেসরকারি ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তা পূর্ব রাজাবাজারের একটি বেসরকারি হোস্টেলে ‘সিঙ্গেল রুম’ বা এক কক্ষে থাকেন। রান্নাঘরের খুপরিতে দরজা লাগিয়ে ঘরটি বানানো হয়েছে। থাকা-খাওয়া বাবদ মাসিক খরচ ৯ হাজার টাকা।

সরকারি–বেসরকারি হোস্টেল নিবাসী ছাত্রীরা বলছেন, বেশির ভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার হোস্টেল নেই, থাকলেও পর্যাপ্ত আসন নেই। অন্যের বাড়িতে ঘর নিয়ে সাবলেট থাকাটা নিরাপদ নয়। ফলে মেসে বা বেসরকারি হোস্টেলে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

এক ছাত্রীর ভাষায়, এসব হোস্টেল হচ্ছে ‘ভালো আয় এবং নীরব নির্যাতনের একটা চলমান ব্যবস্থা’। অন্যদিকে একা কর্মজীবী নারী বাসা ভাড়া পান না। বেসরকারি হোস্টেল বা সাবলেটই ভরসা। রাতে ডিউটি থাকলে ভোগান্তির একশেষ। চাকরি ছাড়ার নজিরও আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামীণ এলাকা থেকে মেয়েরা ঢাকায় পড়তে আসছেন, চাকরিতে ঢুকছেন। আবাসনের অভাবে তাঁরা যাতে ঝরে না পড়েন, সে ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কর্মীদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

রাজধানীতে সরকারের চারটি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে এক হাজারের কিছু বেশি আসন আছে। হোস্টেলমালিকদের একটি সমিতির একজন কর্মকর্তার ধারণা, ঢাকায় সাত শ থেকে আট শ বেসরকারি হোস্টেল আছে। সিংহভাগই নারীদের জন্য। সরকারি হোস্টেলে থাকা-খাওয়া মিলিয়ে খরচ শুরু হয় মাসে হাজারখানেক টাকা থেকে। বেসরকারিগুলোতে খরচ কয়েক গুণ বেশি। কোনো হোস্টেলেই সন্তানসহ থাকা যায় না।

বেসরকারিতে যাচ্ছেতাই

বকশীবাজারে খাবার আর বসার ঘরসহ পাঁচ ঘরের একটি বাসা। এতে থাকেন ১৯ জন মেয়ে। জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা ভাড়া। খাবার খরচ আলাদা। ইডেন মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী এখানে থাকছেন। তিনি বলেন, খাবারের মান ভালো নয়। প্লেটে ভাত নেওয়ার সময় মেসের ব্যবস্থাপক দাঁড়িয়ে থাকেন। ফিরতে হয় রাত ১০টার মধ্যে। কিছু বলতে গেলেই শুনতে হয়, ‘বাসা ছেড়ে দাও’।

মেয়েটি বললেন, আশ্রয় হারানোর ভয়ে সবকিছু মেনে নেন। কলেজের হোস্টেলে সিট পেতে চাইলে খরচাপাতি আছে। আবার ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে হবে। তাই অগতির গতি এই মেস।

গড়পড়তা বেসরকারি ছাত্রী হোস্টেলের পরিবেশ আর খাবারের মান নিয়ে মেয়েরা অসন্তুষ্ট। ফার্মগেট, ধানমন্ডি, লালমাটিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোক্তারা যে যাঁর মতো হোস্টেল খুলে চালাচ্ছেন। সরকারের কোনো নীতিমালা, আইন বা নজরদারি নেই। 

সংগঠনের নাম হোস্টেল মালিক সমিতি, সদস্য ৪১ জন। সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মালিকেরা বাসিন্দার নিরাপত্তার বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তবে খাবারের মান এবং পরিবেশের দিকেও নজর থাকে। তারপরও কিছু হোস্টেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে।

পূর্ব রাজাবাজারে একটি বেসরকারি হোস্টেলের ছোট ছোট ঘরে তিন–চারজন গাদাগাদি করে থাকছেন। প্রত্যেকে একটা কাঠের ছোট চৌকি আর একটা টেবিল পাতার জায়গা পান। কাপড়চোপড়, ব্যাগ—সব রাখতে হয় চৌকির নিচে। বিছানার ওপর দড়ি টানিয়ে ভেজা কাপড় মেলতে হয়। 

এখানকার বাসিন্দা একজন ছাত্রী বলেন, ‘তেলাপিয়া, নলা (ছোট রুই) ও পাঙাশের বাইরে কোনো মাছ থাকে না। কদিন খাওয়ার পরে মুখে তোলা যায় না। আর এক বেলা পরপরই ডিম।’

সরকারিতে সুযোগ কম

জনশক্তি জরিপ ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, দেশের শহরাঞ্চলে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ৫০ লাখের কিছু বেশি। বড় অংশটি কাজ করেন ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানীতে কর্মজীবী নারীদের জন্য নীলক্ষেত, মিরপুর, খিলগাঁও আর বেইলি রোডে চারটি হোস্টেল আছে। এগুলোতে মাত্র ১ হাজার ৮৬ জন নারী থাকতে পারেন। 

আসন সবচেয়ে বেশি নীলক্ষেতে, ৫১৬টি। হোস্টেলটির তত্ত্বাবধায়ক সাবেকুন নাহার প্রথম আলোকে জানান, মাসে চার-পাঁচটি আসন খালি হয়। আর আবেদনপত্র জমা হয় শতাধিক। এখনো ২৫৬টি আবেদন পড়ে আছে। বেশ কয়েকজন নারী বলেছেন, আসন পেতে উচ্চপর্যায়ের তদবির লাগে।

স্বামী চট্টগ্রামে বদলি হলে ঢাকায় এনজিও কর্মকর্তা স্ত্রী একা থাকতে ভয় পেতেন। নীলক্ষেতের হোস্টেলে আসনের জন্য আবেদন করেছিলেন। কয়েক মাস অপেক্ষার পর তিনি চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পারভীন আকতার বলেন, চাহিদার তুলনায় ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। নীলক্ষেত ও মিরপুরের হোস্টেল দুটি বড় করার কাজ চলছে। যথাক্রমে ২৪৫ ও ৩৬৮টি সিট বাড়বে। 

সরকারি হোস্টেলে আসন পেতে অবিবাহিত, বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এমন (কিছু ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য) বোর্ডারকে অন্তত স্নাতক এবং ১৮-৫৯ বছর বয়সী হতে হবে। বেতন হতে হবে ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলের ১৭তম ধাপ বা সমমানের। অর্থাৎ মূল বেতন অন্তত ৯ হাজার টাকা হতে হবে।

হোস্টেলগুলোতে একক থেকে চারজনের ঘর আছে। নিবাসীর সংখ্যা অনুযায়ী থাকা ও খাওয়া মিলিয়ে মাসিক খরচ পড়ে ১ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে।

এখানে নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ নেই, তবে বাসিন্দারা খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ করেন। শৌচাগারের অবস্থাও ভালো নয়। সন্তানসহ থাকার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য সরকারকে হোস্টেল বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাতকেও এক ঘরের ফ্ল্যাট বানানোর প্রকল্প নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকার এসব প্রকল্পে ভর্তুকি দেবে।