নিশ্চয়তা না পেলে মুক্তির আবেদন করতে চান না খালেদা জিয়া

খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

সরকার মুক্তি দেবে, এমন নিশ্চয়তা না পেলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কোনো আবেদন করতে চায় না দল ও পরিবার। বিষয়টিতে বিএনপির চেয়ারপারসনের সায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা।

বিএনপির আইনজীবীরা বলছেন, সরকার চাইলে জামিনের বিরোধিতা না করে বা ‘বিশেষ বিবেচনায়’ খালেদা জিয়ার মুক্তি দিতে পারে। তবে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্য ও বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন নিজের মুক্তির জন্য কোনো আবেদন করতে চান না। তিনি মনে করেন, জামিন পাওয়ার অধিকার তাঁর আছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে কোনো আবেদন বিএনপি বা তাঁর পরিবার কিংবা খালেদা জিয়া নিজে কোনো আবেদন করেননি। ফলে এটি বিবেচনার প্রশ্নও আসছে না। তা ছাড়া দলটির দাবি, খালেদা জিয়ার বিষয়টি সরকারের নয় বরং আদালতের ওপর নির্ভর করছে। সরকারের দায়িত্ব খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। সেটা করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কেউ আবেদন করেননি। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে কেউ আবেদন করেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি খোঁজ নিয়েছেন। বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, সরকারের সঙ্গে এবারের আলোচনায় বিদেশি কূটনীতিকদের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন করা হবে।

যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, দলীয় চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসার জন্য তাঁরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাঁরা যেকোনো উপায়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি চান। কেননা, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা দরকার। নজরুল ইসলামের এই কথার প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কথায়। ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে এবং এর আগে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁকে ফোনে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে বলেছিলেন। তিনি যেটা বলেছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে নানা আলোচনা হলেও তিনি নিজে মুক্তির বিষয়ে নিশ্চয়তা না পেলে মুক্তির জন্য কোনো আবেদন করতে চান না। প্যারোল প্রসঙ্গ বারবার এলেও তাতে তিনি রাজি নন। খালেদা জিয়া মনে করেন, যে মামলায় তাঁকে কারাবন্দী করা হয়েছে, সেই মামলায় জামিন পাওয়াটা তাঁর অধিকার। এটা আদালতকে একসময়ে দিতেই হবে। খালেদার মুক্তির বিষয়ে বিএনপির নেতারা বলছেন, মুক্তির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো দেওয়া শর্ত হতে পারে। আর তাতে রাজি হলে মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।

খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বোন খুবই অসুস্থ। তাঁরা যেকোনো উপায়ে তাঁর মুক্তি চান। প্যারোলে হলেও। কেননা, তাঁর সুচিকিৎসা দরকার। তিনি বলেন, তারা পরিবারের পক্ষ থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। তাঁরা চান খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসা দিতে। এ জন্য মেডিকেল বোর্ড সুপারিশ করলে সুবিধা হয়।

দুর্নীতির দুটি মামলায় ১২ বছরের সাজা নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কারাবন্দী। দুই বছর জেলে আছেন বিএনপি নেত্রী। গত বছর অসুস্থ হলে খালেদা জিয়াকে ১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। এখন পর্যন্ত তিনি সেখানেই আছেন।

খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার জন্য তাঁর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে বিএনপি। মানবিক বিবেচনায় খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে তাঁর আইনজীবীরা আবেদন করলেও তা খারিজ হয়ে যায়। সর্বশেষ গত ১২ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানিতে মেডিকেল রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। হাইকোর্টের আপিল বিভাগ জামিন আবেদন খারিজ করে খালেদা জিয়ার সম্মতিতে বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী চিকিৎসার নির্দেশ দেন। আদালতের এমন নির্দেশ পাওয়ার পর শিগগিরই আইনি পথে খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে বলে মনে করছে না তাঁর দল এবং তিনি নিজেও। বিএনপির শীর্ষ আইনজীবীরাও দীর্ঘদিন ধরে তা বলে আসছেন।

বিএসএমএমইউতে এখন খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরাই দেখা করতে পারেন। মাসে দুবার গিয়ে তাঁরা দেখা করেন। তাঁর পরিবারের এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, দেখা করতে গেলে খালেদা জিয়া তাঁর মুক্তির বিষয়ে তেমন কথা বলেন না। তবে সরকারের তরফ থেকে তাঁর জামিন আবেদনে বিরোধিতা করা হবে না, এমন নিশ্চয়তা পেলে পরবর্তী সময়ে জামিনে আবেদন করা যেতে পারে বলে তাঁর সম্মতি আছে। এটা দলকেও জানানো হয়েছে। দল থেকেও এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হচ্ছে বলে জানান খালেদা জিয়ার পরিবারের এই সদস্য। তবে সরকার থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি।

খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ২০–দলীয় জোটের এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য তাঁরা সব প্রক্রিয়াতেই চেষ্টা করেছেন। তাঁর সুচিকিৎসার জন্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলেও জানান। এ ছাড়া বিএনপির এক দায়িত্বশীল নেতা জানান, সরকারের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, তবে সেটা আনুষ্ঠানিক কিছু নয়। আলোচনায় দু পক্ষই লাভবান না হলে আলোচনা বেশি দূর যাবে না বলেও জানান। বিএনপির এই সূত্র জানায়, সরকার নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে মুক্তির কোনো চেষ্টা করে লাই নেই। তবে তৃতীয় কোনো পক্ষের সমঝোতায় সন্তোষজনক সমাধান না হলে কোনো পক্ষই ছাড় দেবে না বলে জানান তিনি।

প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। তবে বিএনপির নেতারা বরাবরই তা নাকচ করে দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার পরিবারের এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, প্যারোল বিষয়ে তাদের মনোভাব হচ্ছে তিনি কোন গ্রাউন্ডে প্যারোল চাইবেন? প্যারোল চাইলে সরকার দেবে কিন্তু তা নিয়ে বড় ধরনের রাজনীতিও করবে। প্যারোলে মুক্তি পেলে তাঁকে হয়তো চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হবে। তা ছাড়া প্যারোলের সময়সীমার একটা ব্যাপার আছে।

বিএনপি থেকে প্রায়ই বলা হয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি জন্য রাজপথে নামতে হবে, আন্দোলন করে মুক্ত করবে তাদের নেত্রীকে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে নয়। সভা, সমাবেশ, অনশন বাদে কিছুই করতে পারেনি দল। নিজেদের ব্যর্থতার কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন দলের শীর্ষ নেতারা। দলের এমন অবস্থা নিয়ে খালেদা জিয়াও অবগত। তাঁর পরিবারের এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো পরিস্থিতিতে তাঁর দল নেই। দল এখন যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা সব খালেদা জিয়ার সম্মতিতেই হচ্ছে।

বিএনপির এক স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় গেলে সরকার অন্তত কোনো একটা শর্ত চাইবে। সেটাতে যদি বিএনপি রাজি হয়, তাহলে হয়তো মুক্তি হতে পারে। তবে এটা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, তেমন এগোয়নি বলে জানান দলের অন্যতম এই শীর্ষ নেতা। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালেদার মুক্তি দলের সবচেয়ে বড় চিন্তা। আইনি পথে তাঁর মুক্তি হবে না। কিছু একটা করতে হবে। এভাবে তো জেলে রাখা যাবে না ওনাকে।’