বিরোধীদের সামলে নিয়েছেন কাদের

জি এম কাদের। ফাইল ছবি
জি এম কাদের। ফাইল ছবি

এরশাদের মৃত্যুর পর দলের কর্তৃত্ব নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে শৃঙ্খলায় ফিরছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। এরই মধ্যে বৈরী মনোভাবাপন্ন জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রায় সামলে নিয়েছেন জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এখন তাঁর মনোযোগ সকল পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠনে, যাতে অনেক পুরোনো নেতা বাদ পড়ছেন। তবে দলের নেতারা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে জাপায় নিয়ন্ত্রণ অনেকটা পোক্ত করছেন কাদের।

গত ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনে জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। এরপর এ পর্যন্ত কয়েক ধাপে দলের ২৯৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। আগে ছিল ৬০০ সদস্যবি​শিষ্ট কমিটি। এবার অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে ৩৭ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪১ জন, যুগ্ম মহাসচিব পদে ১৬ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ৩১ জন, যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ৩১ জন, বিভাগীয় সম্পাদক পদে ২২ জন, যুগ্ম বিভাগীয় সম্পাদক পদে ২৩ জন এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ৯০ জন।

জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় কমিটি হবে সর্বোচ্চ ২৯৯ সদস্যের। সে হিসাবে আরও নয়জনকে কমিটিতে যুক্ত করার সুযোগ আছে। এর মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে চারটি পদ খালি আছে। এরই মধ্যে কমিটি গঠন নিয়ে দলের একটা অংশের মধ্যে ক্ষোভ–বিক্ষোভও আছে। তাঁদের দাবি, পুরোনো অনেকে পদ পাননি, আবার অনেক অপরিচিত নেতা কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদপন্থী বলে পরিচিতদের অনেককে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ দেওয়া হয়নি।

এরপর গত জানুয়ারিতে রওশন এরশাদ তাঁর ছেলে রাহগির আল মাহিসহ (সাদ এরশাদ) ১৬ জনকে পদায়ন করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠালে দলে হইচই পড়ে। তাতে ছেলে সাদসহ ১১ জনকে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করেন রওশন। যদিও এটা রওশনের এখতিয়ারবহির্ভূত বলে নাকচ করে দেন জি এম কাদের।

>

দলের ভেতরে বৈরী মনোভাবাপন্ন জ্যেষ্ঠ নেতাদের সামলে নিয়ে দলে নিয়ন্ত্রণ অনেকটা পোক্ত করছেন জি এম কাদের

কমিটির এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জাপার মহাসচিব মসিউর রহমান। তাঁর দাবি, সবগুলো কমিটি দিয়েছেন চেয়ারম্যান। তবে মসিউর রহমান বলেছেন, ‘আগে কমিটি ছিল ৬০০ লোকের, সেটা গঠনতান্ত্রিক করতে গেলে ৩০০ জন বাদ পড়ে। যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা তো ক্ষুব্ধ হবেনই।’

জাপার নতুন কমিটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধশত নেতা কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন। এর মধ্যে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ গেছেন ১০ জন পুরোনো নেতা। তাঁদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী এম এ সাত্তার, দেলোয়ার হোসেন খান, নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী, পুরোনো নেতা খালেদ আখতার, আতিকুর রহমান, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, মজিবুর রহমান, কাজী মামুনুর রশীদ ও দিলারা খন্দকার অন্যতম। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে ৭ জন করে ১৪ জন এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পদ থেকে ১৫ জন বাদ পড়েছেন। রওশন এরশাদের তালিকায় যে ১১ জনের নাম সভাপতিমণ্ডলীতে ছিল, তাঁদের কাউকে সভাপতিমণ্ডলীতে রাখা হয়নি। তবে সাদ এরশাদকে যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে। নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, দলে রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠদের কমিটিতে রাখা হয়নি।

জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের এ অভিযোগ নাকচ করে দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁদের বাদ দিয়েছি তাঁরা অপদার্থ। বাদ পড়ার পর তাঁরা এখন উনার (রওশন) লোক সাজছেন। তাঁর সঙ্গে যাঁরা মূলত ঘুরতেন, তাঁদের তো ভালো জায়গায় রেখেছি।’

জাপার নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, ফকরুল ইমামসহ অনেকে রওশনপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। সম্মেলনের পর এঁদের সবাইকে কো-চেয়ারম্যান পদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আত্মীয়তার কারণে জিয়াউদ্দিন আহমেদ এখন জি এম কাদেরের সঙ্গে। এ অবস্থায়  চুপচাপ আছেন রওশন এরশাদ।

জাপার সাংগঠনিক জেলা ৭৬টি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর ও মানিকগঞ্জ জেলার নেতার সংখ্যা কেন্দ্রীয় কমিটিতে বেশি। এর মধ্যে ঢাকা জেলা থেকেই পদ পেয়েছেন ৫১ জন।  এ বিষয়ে জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে চাই। আগে কিছু লোক টাকাপয়সা দিয়ে কমিটিতে এসেছেন। তাঁরাই এখন সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্মেলনে দল পুনর্গঠনে চেয়ারম্যানকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এখন কাকে কোথায় রাখা হবে, তাঁর সম্পূর্ণ এখতিয়ার চেয়ারম্যানের। এখানে কারও হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই।’

তবে দলীয় একটি সূত্র জানায়, পুরোনো নেতা এম এ সাত্তার, দেলোয়ার হোসেন খান, নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী, খালেদ আখতার ও কাজী মামুনুর রশীদকে বাদ দেওয়া নিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ কেউ বিরক্ত। আরেকটি সূত্রের দাবি, বাদ পড়া নেতাদের কেউ কেউ জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরানোর ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে কাজী মামুনুর রশীদ সম্মেলনের আগে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন।

জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু লোক তো আগাগোড়াই আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। তবে বেশির ভাগ নেতা-কর্মী কমিটি নিয়ে সন্তুষ্ট। কারণ, অনেক যাচাই–বাছাই করে অনেককে বড় জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছি। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ৫৬ জন থেকে ৩৭ জনে নিয়ে এসেছি। যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরাই লাফালাফি করছেন।’