টানা দুই বছর কমছে জনশক্তি রপ্তানি

জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় তিনটি শ্রমবাজারের মধ্যে দুটি কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। এর মধ্যে ১৬ মাস ধরে বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। আর সাত বছর ধরে কর্মী পাঠানোয় গতি নেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে। নতুন করে বড় কোনো শ্রমবাজারেও ঢুকতে পারেনি বাংলাদেশ। তাই ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে বিদেশে কর্মী পাঠানো। আগের বছরের তুলনায় গত বছর প্রায় ৫ শতাংশ কর্মী কম গেছেন বিদেশে। তার আগের বছর কমেছিল ২৭ শতাংশ।

বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি মূলত মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে।  জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত বছর মোট বিদেশে যাওয়া কর্মীর ৯০ শতাংশ গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। শুধু সৌদি আরবে গেছেন ৫৭ শতাংশ কর্মী। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরতা থাকায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে প্রবাসী শ্রমবাজার। বিশ্বজুড়ে দক্ষ কর্মীর চাহিদা আছে, যা ধরতে পারছে না বাংলাদেশ।

তবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, দক্ষ কর্মী পাঠানোয় জোর দিচ্ছে সরকার। গত বছর বিদেশে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ ছিলেন দক্ষ কর্মী। এর আগের বছর দক্ষ কর্মী গেছেন ৪৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ ৬ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সারা বিশ্বে অদক্ষ কর্মীদের চাহিদা কমে যাচ্ছে। সবাই দক্ষ কর্মী নিতে চায়। যত বেশি কর্মী দক্ষ করতে পারব, তত বেশি কর্মী বিদেশে পাঠাতে পারব।’

শিগগিরই খুলছে না মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির গঠিত একটি চক্র। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। গত বছর দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠকেও কোনো ফল আসেনি। শিগগিরই এ শ্রমবাজার খোলার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, এ মাসের শেষের দিকে ঢাকায় দুই দেশের যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় গেছেন প্রায় ১ লাখ কর্মী। ২০১৮ সালেও দেশটিতে গেছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার কর্মী। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর দেশটিতে গেছেন মাত্র ৫৪৫ জন।

মধ্যপ্রাচ্যেও সংকোচনের শঙ্কা

১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। দেশটিতে ৪০ লাখের বেশি কর্মী গেছেন বিভিন্ন কাজ নিয়ে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩ লাখ ৭১ হাজার কর্মী গেছেন আরব আমিরাতে। তাঁদের মধ্যে ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সাত বছর ধরে প্রতিবছর ২ লাখের বেশি কর্মী গেছেন। এরপর গত সাত বছরে সব মিলিয়ে ১ লাখ কর্মীও পাঠানো যায়নি দেশটিতে। গত বছর আরব আমিরাতে গেছেন মাত্র ৩ হাজার কর্মী। গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরব আমিরাত সফরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

>

বৃহত্তম তিনটি শ্রমবাজারের মধ্যে আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় অচলাবস্থা
প্রবাসী আয়ে রেকর্ড হলেও ভবিষ্যতে কমতে পারে প্রবৃদ্ধি

গত বছর সৌদি আরবে গেছেন ৪ লাখ কর্মী। এ বাজারে কর্মী পাঠানোর ধারা অব্যাহত রাখা হুমকির মুখে পড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ বেকারত্ব কমাতে ১২ ধরনের কাজে কোনো বিদেশি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি আরব। অবৈধ কর্মীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে কড়া অভিযান চালাচ্ছে দেশটির পুলিশ। নিয়মিত আটক হয়ে দেশে ফিরে আসছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। এ ছাড়া সম্প্রতি কাতার জানিয়েছে, দক্ষ ছাড়া কোনো কর্মী নেবে না দেশটি।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে বিমানভাড়া বেড়ে যাওয়ায় কর্মী পাঠাতে অসুবিধায় পড়ছেন বলে জানিয়েছে বেসরকারি খাতের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা।বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়া ও আমিরাতের মতো দুটি বড় শ্রমবাজার বন্ধ থাকার পরও কর্মী পাঠানো উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি। এ দুটি বাজার চালু হলে বছরে ১০ লাখের বেশি কর্মী পাঠানো যাবে। বেশ কিছু বাজার ছোট পরিসরে চালু হয়েছে।

১৫ শতাংশ নারী কর্মী

সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠাতে ২০১৫ সালে দেশটির সঙ্গে চুক্তি করার পর থেকে বিদেশে নারীর কর্মসংস্থান বাড়তে শুরু করেছে। ওই বছর প্রথমবারের মতো ১ লাখ নারী কর্মী কাজ নিয়ে যান বিভিন্ন দেশে। পরের চার বছরেও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। প্রতিবছরই ১ লাখের বেশি নারী কর্মী যাচ্ছেন বিদেশে। গত বছর গিয়েছেন ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬ নারী। গত বছর বিভিন্ন দেশে যাওয়া মোট কর্মীর মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী কর্মী। যদিও তাঁদের অনেকে ফিরে এসে নির্যাতন–নিপীড়নের অভিযোগ করছেন। 

প্রবাসী আয়ে রেকর্ড ও শঙ্কা

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর প্রবাসীরা ১ হাজার ৮৩৩ কোটি মার্কিন ডলারের আয় পাঠিয়েছেন, দেশের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এসেছিল ১ হাজার ৫৫৩ কোটি ডলার। সেই হিসাবে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ শতাংশ। তবে বিদেশে কর্মী পাঠানো কমতে থাকলে কমে আসতে পারে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির হার।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসী কর্মী কমলেও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকের মোট সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। তাই আগের বছরের তুলনায় প্রবাসী আয় কমবে না, কিন্তু একই প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে, বরং কমে যাবে প্রবৃদ্ধির হার। আর টানা দুই বছর বিদেশে কর্মী কমে যাওয়ার প্রভাবও বছরখানেক পর দৃশ্যমান হবে।

নতুন শ্রমবাজারে ছোট সম্ভাবনা

নতুন করে কয়েকটি শ্রমবাজার চালু হলেও তা বড় সম্ভাবনা দেখাচ্ছে না। দক্ষ কর্মী পাঠানোর মধ্য দিয়ে বড় আয়ের উৎস হতে পারে জাপান। গত বছরের আগস্টে জাপানের রাজধানী টোকিওতে দুই দেশের মধ্যে এ–সংক্রান্ত সহযোগিতা স্মারক সই করেছেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা। এতে জাপানের ১৪টি খাতে বিশেষায়িত দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়। বিনা খরচে জাপানে যাবেন দক্ষ কর্মীরা। আগামী পাঁচ বছরে সাড়ে ৩ লাখ বিদেশি কর্মী নেবে জাপান।

পূর্ব আফ্রিকার দেশ সিশেলসের বাজার নতুন করে চালু হয় গত অক্টোবরে। এখানেও বিনা খরচে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন কর্মীরা। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার কর্মী পাঠানোর সুযোগ আছে ছোট্ট এ দেশটিতে। বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার বাংলাদেশি কর্মী কাজ করেন সেখানে। কম্বোডিয়া, হার্জেগোভিনা, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও চীনে কিছু কিছু করে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে ও কিছু লুটেরা এজেন্সির ওপর নির্ভর করে বিদেশের শ্রমবাজার। ভাগ্যনির্ভর বাজার বদলাতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে বেশি দূর যেতে পারবে না। দক্ষ কর্মী তৈরিতে আমূল সংস্কার প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষাকে আলাদা না রেখে একসঙ্গে করে দক্ষ কর্মী তৈরিতে জোর দেওয়া উচিত সরকারের।