ভালোবাসা আসুক বিষণ্ন শহরে

প্রবল প্রতিকূল পরিবেশে সৌরভ না ছড়ালেও এ শহরে সৌন্দর্য ছড়াতে এসেছে আমের মুকুল। ছবি: লেখক
প্রবল প্রতিকূল পরিবেশে সৌরভ না ছড়ালেও এ শহরে সৌন্দর্য ছড়াতে এসেছে আমের মুকুল। ছবি: লেখক

অঞ্জন দত্ত এসেছিলেন আমাদের শহরে। বরাবরের মতো এ শহরকে নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার কথা বলে গেলেন। আমরা পড়েছি ও শুনেছি। উদ্বেলিত হয়েছি। কিন্তু যাদের যাপিত জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এই শহর, তারা কি হলফ করে এ শহরের জন্য মুগ্ধতার কথা বলতে পারি? পারি না।

কেন পারি না, তার অনেক ব্যাখ্যা অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া যায়। আমরা দিইও। তারপরও আপন করে নিতে পারি না তাকে। এই শহরের অদৃষ্টে তাই ভালোবাসা লেখা নেই। আছে বিরহী প্রেমিকের দুঃখগাথা।

অথচ কী আশ্চর্য, এই শহরকে ঘিরেই আমাদের স্বপ্ন, আমাদের বসতি, আমাদের বাস্তবতা। বুননের পর বুনন দিয়ে একে ঘিরেই আমাদের সাজানো স্বপ্ন আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু আমরা কখনো বলিনি, তোমায় ভালোবাসি প্রিয়তমা। বলতে পারিনি। বরং প্রতিদিনের উপর্যুপরি দোহনে ধূসর করে তুলেছি একে। দিন শেষে শ্রীহীন হয়েছে আমাদের শহর।

আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি আর গ্যাসের নীলচে শিখায় ঘন হতে থাকা দুধের মিঠে সর খেয়েছি কখনো আঙুল দিয়ে, কখনো খাবলে খাবলে। এই শহরের গোপন গহিনে আমাদের অগোচরে তার শিরায়–উপশিরায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তার উপশমের কোনো ব্যবস্থা করিনি। শুধু নিয়েছি দুহাত ভরে, দিইনি কিছুই। ফলে অভিমানের বাষ্প জমেছে এই শহরের বুকে। এই বাষ্প যদি বুদ্‌বুদ না হয়ে অগ্নিগিরির লাভা হয়ে ওঠে, আমাদের কিছুই করার থাকবে না। আমরা স্রেফ ধ্বংস হয়ে যাব।

বিসদৃশ কলেবরে বেড়ে উঠেছে আমাদের শহর। আকাশ ঢেকে গেছে। ধুলোর পরত জমে গেছে বাতাসে। গাছগুলো এখানে বৃক্ষ নয়, বনসাই। অক্সিজেন ছাড়তে ছাড়তে নিজেই ক্ষয় রোগী হয়ে গেছে বনসাইগুলো। পাতাগুলো সবুজ নয়, ধুলোর আবরণে সাদাটে। এ শহরের সঙ্গে সদ্ভাব নেই প্রকৃতির। এখানে শিশুরা নির্মল নয়, হাসে না ঠিক খলখলিয়ে।

এ শহরে মানুষ নেই। আছে শরীর বিকিয়ে জীবন কাটানো নির্বিষ নাগরিক, প্রতিবেশীর সঙ্গে যার ঝগড়া হয় না। এ শহরে হিংসুটে প্রতিবেশী নেই, ব্যাগভর্তি বাজার দেখে যে বলবে—ঢং! এ শহরে সহমর্মী নেই। আছে বৈভবের বৃত্তবন্দী মানুষ, সহনাগরিকের জন্য যার মন কেমন করার সময় নেই। আছে গলির মুখে বেওয়ারিশ কুকুর, প্যাকেট প্যাকেট খাবার ডাস্টবিনে গেলেও যারা অভুক্ত থাকে। আমাদের শহরে নেতা নেই, যিনি ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে চন্দ্রগ্রস্ত হয়ে বলবেন, নিয়ন আলো বন্ধ থাক। চলো হে, জোছনায় ভাসিয়ে দিই চরাচর।

বিচ্ছিন্ন ধূসর এ শহরে বসন্ত এসেছে। প্রবল প্রতিকূল পরিবেশে সৌরভ না ছড়ালেও এ শহরে সৌন্দর্য ছড়াতে এসেছে আমের মুকুল। ভালোবাসার দিন চলে গেলেও ভালোবাসা আসেনি আমাদের বিষণ্ন শহরের জন্য।