বিদেশ গমনে দালালের দৌরাত্ম্য, খরচ বেশি

এএফপি ফাইল ছবি
এএফপি ফাইল ছবি

ত্রিশাল উপজেলার শফিকুল ইসলাম দালালের মাধ্যমে কাতার যাচ্ছেন। এতে তাঁর খরচ হবে আট লাখ টাকা। তাঁর মতোই গফরগাঁও উপজেলার মো. জুয়েল বিদেশ যাবেন। সৌদি আরবে যেতে তাঁর খরচ হবে সাড়ে চার লাখ টাকা। এ রকম আরও বেশ কয়েকজন যুবক—তাঁরা কেউ সিঙ্গাপুর, কেউ কুয়েত যাবেন। দালালের মাধ্যমে বিদেশ যেতে তাঁদেরও গড়ে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা খরচ হচ্ছে।

অথচ তাঁদের কারওরই কোনো কর্মদক্ষতার প্রশিক্ষণ নেই। নেই কোনো সনদও। যেসব দেশে যাচ্ছেন, সেসব দেশের ভাষাজ্ঞানও নেই। তাঁদের সঙ্গে কথা বরে এসব তথ্য জানা গেল। সম্প্রতি তাঁরা ময়মনসিংহ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তিন দিনব্যাপী ‘প্রি-ডিপার্চার ওরিয়েন্টেশন’ শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নেন। এখানে তাঁরা সবাই বিভিন্ন দেশের ভিসা পেয়ে বিদেশ ভ্রমণের 

আচার আচরণ ও কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন। কথা বলে আরও জানা যায়, তাঁদের কারোরই ‘আকামা’ বা কাজের অনুমতিপত্র নেই। এমনকি নেই কোনো চুক্তিপত্রও। তাঁরা কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যাচ্ছেন, সেটির নামও জানেন না।

ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে জানা যায়, এখানে সিভিল, ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রিক্যাল, প্লাম্বিং, ওয়েল্ডিং, মেকানিক্যাল, অটোমোবাইল, গার্মেন্টসসহ মোট ১১টি বিষয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আশানুরূপ প্রশিক্ষণার্থী না পাওয়ায় সেই কোর্সগুলোর কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। এই প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদেশে যেসব শ্রমিক যাচ্ছেন, তাঁদের ৯৫ শতাংশই অদক্ষ শ্রমিক বলে জানিয়েছেন এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দীন আহমদ। এ জন্য তিনি সরাসরি দালালদের দৌরাত্ম্যকেই দায়ী করেছেন।

বিদেশ গমনেচ্ছুক শ্রমিকেরা অভিযোগ করেন, পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার সময়ও দালালদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হচ্ছে। আর সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে তাঁরা অবগত নন বলে জানান। এ কারণেই দালালদের টাকা দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন ব্যক্তি। এ ছাড়া টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রেও তাঁদের কাছে কোনো প্রমাণাদি নেই বলে জানিয়েছেন প্রশিক্ষণ নিতে আসা শ্রমিকেরা। তাই তাঁরা জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসকে সহযোগিতায় তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান।

ময়মনসিংহ জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস সূত্রে জানায়, তাঁরা ইতিমধ্যেই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রচারণা কার্যক্রম শুরু করেছেন। এখন বিদেশ যেতে এক-দুই লাখ টাকা খরচ হয় সর্বোচ্চ। তাই কেউ যেন দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা না করে, সেই আহ্বান করা হয়। কেউ প্রতারিত হলে তাঁদেরকে ২০১৩ অভিবাসী আইনে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

তবে গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ময়মনসিংহ জেলায় বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। যেখানে ২০১৭ সালে ২০ হাজার ৫৯ জন পুরুষ এবং ২ হাজার ৬২১ জন নারী বিদেশে গিয়েছিলেন, সেখানে ২০১৮ সালে ১৭ হাজার ৫০০ পুরুষ এবং ১ হাজার ৯৯৭ জন নারী এবং চলতি বছরে ১৩ হাজার ২৮৫ জন পুরুষ এবং ১ হাজার ৫৪১ জন নারী শ্রমিক বিদেশে গিয়েছেন।

জনশক্তি রপ্তানিতে ময়মনসিংহ জেলা পিছিয়ে পড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক লেহাজ উদ্দীন বলেন, জেলায় কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি নেই। দালালের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। এ ছাড়া শ্রমিকদের অদক্ষতার ফলে তাঁরা বিদেশে গিয়ে তেমন একটা সুবিধা করতে না পেরে দেশে ফেরত আসছেন। তাই নতুন করে বিদেশে যাওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে আসছে। এ ছাড়া দুবাই ও মালয়েশিয়াতে বর্তমানে শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে—সেটিও আরেকটি কারণ।

তিনি দাবি করেন, দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় তাঁরা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছেন। সরকারিভাবে বৈধ উপায়ে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করার ব্যাপারেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক হতে ঋণ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ময়মনসিংহ শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মুক্তারা রহমান জানান, জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রায় ৭০ জন বিদেশগামী শ্রমিক ৯৬ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছেন।