সেবা নিলেই গাছ উপহার

ভূমি অফিসের সেবাগ্রহীতার হাতে গাছের চারা তুলে দিচ্ছেন এসিল্যান্ড শামসুল আরিফীন। গত মঙ্গলবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুরে।  প্রথম আলো
ভূমি অফিসের সেবাগ্রহীতার হাতে গাছের চারা তুলে দিচ্ছেন এসিল্যান্ড শামসুল আরিফীন। গত মঙ্গলবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুরে। প্রথম আলো

প্রকৃতিতে সবুজ বাঁচাতে এক উদ্যোগ নিয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা ভূমি অফিস। এই অফিসে ভূমিসংক্রান্ত কোনো সেবা নিলেই সেবাগ্রহীতাকে দেওয়া হয় দুটি ফলদ গাছের চারা। ভূমির সঙ্গে গাছের সম্পর্ক যেখানে নিবিড়, সেখানে জমি থাকবে, গাছ থাকবে না, এ হতে পারে না—এমন ভাবনা থেকেই এই উদ্যোগ নিয়েছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড শামসুল আরিফীন নিজে।

উপজেলার এসিল্যান্ড অফিসসহ সব কটি ভূমি অফিসে প্রত্যেক সেবাগ্রহীতাকে এই গাছ দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে সাত মাস আগে। প্রকৃতি বাঁচাতে এসিল্যান্ডের এমন উদ্যোগে গ্রাহকেরা খুশি। অনেকেই গাছের চারা উপহার পেয়ে গাছ লাগানোর গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করছেন। অনেকে নতুন কেনা জমিতে উপহার পাওয়া দুটি গাছের চারার সঙ্গে আরও চারা কিনে রোপণ করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

গত সোমবার একটি জমির নামজারির কাজে এসিল্যান্ড অফিসে গিয়েছিলেন কাজী সোহেল উল্লাহ আহসান। সব কাজ শেষে অফিস থেকে যখন তাঁকে দুটি ফলদ গাছের চারা উপহার দেওয়া হলো, তাঁর কাছে কিছুটা অবাক লাগল বিষয়টি। চারাটি তাঁর হাতে তুলে দিলেন এসিল্যান্ড নিজে। এর আগে তিনি কোথাও এমনটি দেখেননি বলে জানান। ভূমি অফিসের এই মহতী উদ্যোগ সেবাগ্রহীতাদের আস্থা ও প্রশংসা কুড়াতে শুরু করেছে।

গত সোম ও বৃহস্পতিবার ভূমি অফিসের এই উদ্যোগ দেখতে এই প্রতিবেদক উপজেলা পরিষদ চত্বরে যান। সেখানে দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট স্থানে উপজেলা প্রশাসনের মালি গাছের চারার যত্নআত্তিতে ব্যস্ত। এসিল্যান্ড অফিসের সামনে বারান্দায় রাখা আছে অনেকগুলো গাছের চারা। কাজ শেষে এসিল্যান্ড অফিসের আঙিনা থেকে ফিরছেন ৩-৪ জন সেবাগ্রহীতা। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে দুটি করে গাছের চারা। অনেকেই গাছের চারা হাতে পেয়ে নিজেদের এই নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করছেন।

ভূমি অফিস চত্বরে এ নিয়ে কথা হয় কয়েকজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে। তাঁদের একজন কাজী সোহেল উল্লাহ আহসান। তিনি বলেন, তিনি শ্রীপুরে জমি কিনেছেন অনেক দিন হয়। কিন্তু সেখানে গাছ লাগানো হয়নি। এবার ডিসিআর জমা দিতে গিয়ে দুটি গাছের চারা উপহার পেলেন। তিনি বলেন, এই উপহার তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেলেছে। তিনি আরও কিছু গাছ কিনে পড়ে থাকা জমিতে লাগানোর ইচ্ছের কথা জানান।

মোহাম্মদ খলিল নামের একজন এসিল্যান্ড অফিসে কাজ শেষ করে দুটি কাঁঠালগাছের চারা উপহার পেয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই উদ্যোগটি চমৎকার। সবাই শুধু গাছ কাটছে। গাছের রোপণে কেউ তেমন উৎসাহী হচ্ছে না। উদ্যোগটি এ ক্ষেত্রে পরিবেশ বাঁচাতে খুব ভালো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।

আবুল বাসার নামের আরেকজন নামজারি করে মেহগনি ও কাঁঠালগাছের চারা উপহার পেয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নামজারি করলাম। কাজ শেষে আমাকে গাছ দেওয়া হলো। প্রথমে তো অবাক হয়ে গেলাম। পরে স্যার বললেন, এখন থেকে সেবা নিলে গাছ দেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, দেশের কোথাও এমন দেখিনি। এভাবে মানুষকে গাছ লাগানোর উৎসাহ দেওয়া হলে পরিবেশের পাশাপাশি মানুষেরও সুরক্ষা হবে।

জাহাঙ্গীর আলম নামের একজন বলেন, কিছুদিন আগে তিনি গোসিংগা ভূমি অফিসে গিয়েছিলেন। কাজ শেষে তাঁকে জাম ও পেয়ারাগাছের চারা উপহার দেওয়া হয়। তিনি গাছগুলো বাড়ির আঙিনায় রোপণ করেছেন। 

এ বিষয়ে কথা হয় গোসিংগা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. আবদুল ওয়াহাবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এটি খুব ভালো উদ্যোগ। এসিল্যান্ড মহোদয়ের এই উদ্যোগের পর আমরা আমাদের ভূমি অফিস থেকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি গাছ উপহার দিচ্ছি। যাঁরা গাছ নিচ্ছেন, তাঁরা বিষয়টি খুব ভালোভাবে নিয়েছেন। এভাবে সবাইকে সচেতন করতে পারলে পরিবেশ সুরক্ষা হবে। সমাজে একধরনের পরিবর্তন আসবে।’

কথা হয় গাছের চারা দেওয়ার এমন উদ্যোগের রূপকার শ্রীপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শামসুল আরিফীনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বেশি বেশি গাছ লাগাতে চাই। গাছ সুরক্ষায় সরকারের যে উদ্যোগ, সে উদ্যোগে সহযোগী হতে চাই। তাই সরকারি অফিসের কর্মকর্তা হিসেবে আমি এই উদ্যোগ নিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমি যখন এসিল্যান্ড হিসেবে যোগদান করি, তখন পরিবেশবিষয়ক কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে পরিবেশদূষণ ও গাছ কাটার ভয়াবহ চিত্র দেখি। অথচ শ্রীপুর হলো সবুজে ঘেরা ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি উপজেলা। তখন থেকেই মনে মনে ভাবলাম, এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না। অফিসের সবার সঙ্গে কথা বলে শুরু করে দিলাম। এখন দেখছি, সবাই খুব খুশি। অনেকেই সেবা নিয়ে গাছ উপহার পেয়ে সেগুলো রোপণ করে ফোন দিয়ে জানাচ্ছেন।’ এসিল্যান্ড বলেন, পরিবেশ সুরক্ষায় বাড়ির আশপাশসহ পরিত্যক্ত সব জায়গায় প্রচুর গাছ লাগানো উচিত। এভাবেই একটু একটু করে সবার সমন্বিত উদ্যোগে বাংলাদেশটা বদলে যাবে।