বিজ্ঞাপনে মোড়ানো গণপরিবহন, ঝুঁকিতে নারীর নিরাপত্তা

বিজ্ঞাপনে মোড়ানো বাস রাজধানীতে চলাচল করছে। ছবি: সংগৃহীত
বিজ্ঞাপনে মোড়ানো বাস রাজধানীতে চলাচল করছে। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীতে বিভিন্ন সড়কে কিছু গণপরিবহন চলাচল করছে, যার পুরোটাই বিজ্ঞাপনে মোড়ানো। বিজ্ঞাপনে ঢেকে আছে গণপরিবহনের দরজা–জানালা। বাইরে থেকে ভেতর বা ভেতর থেকে বাইরে দেখার কোনো উপায় নেই। নারী অধিকারকর্মী, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের পরিবহন নারীর জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। গণপরিবহনের ভেতরে নারী যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের শিকার হলে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না বা ওই নারী কারও সাহায্য নিতে পারবেন না।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির দ্রুত সমাধানেরও আশ্বাস দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একই সঙ্গে বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও বিজ্ঞাপন লাগানো গণপরিবহন কর্তৃপক্ষকেও বিষয়টি বোঝাতে হবে।

এ ধরনের বিজ্ঞাপনে মোড়ানো একটি বাসে ওঠার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী যাত্রী বলেন, ‘বাসের পর্দা সরানো হলে একটু আলো হয় ভেতরটা, এরপরও ভেতরটা অন্ধকারই বলা চলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি বাসের ভেতর থেকে বাইরে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, একইভাবে বাইরে থেকেও ভেতরটা কেউ দেখতে পাবেন না। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে ছিলাম বলে হয়তো বিষয়টি নিয়ে ততটা চিন্তা করিনি। কিন্তু একা এ ধরনের বাসে চলাচল অবশ্যই বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করবে।’

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর শাহানা হুদা বলেন, ‘আমি ধানমন্ডির ২৭ নম্বর এবং জাহাঙ্গীর গেটে এ ধরনের বাস দেখতে পাই। গণপরিবহনের ভেতরে স্বল্প আলোসহ বিভিন্ন বিষয় এমনিতেই নারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে রেখেছে। বর্তমানে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বেড়েছে। এমনকি প্রকাশ্যেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটাতে সাহস পাচ্ছে যৌন নির্যাতকেরা। সেখানে এ ধরনের চারপাশ বন্ধ বা মোড়ানো পরিবহন কেমন করে সড়কে চলাচল করছে? ভেতরে কোনো নারী হয়রানির শিকার হলে কেউ তা বুঝতেও পারবে না। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’

২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপরিবহনে গত ১৩ মাসে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে এ তথ্য দিয়েছিল সংগঠনটি।

গত বছরের ৬ মে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে শাহিনুর আক্তারকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়—এ অভিযোগে বাজিতপুর থানায় মামলা করেছেন নিহত শাহিনুরের বাবা গিয়াস উদ্দিন। ওই মামলায় বাসচালক, সহকারীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রূপা খাতুনকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়।

২০১৫ সালে মে মাসে কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরার পথে রাজধানীতে গণধর্ষণের শিকার হন পোশাকের দোকানে কাজ করা এক গারো তরুণী (২২)। কুড়িল বাসস্ট্যান্ড থেকে তাঁকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে একদল দুর্বৃত্ত। এভাবে শাহিনুর, রূপা খাতুনদের নামের তালিকা শুধু বাড়ছেই। ২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ শতাংশ নারী কোনো না কোনো সময়ে মৌখিক, শারীরিক বা অন্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বললেন, ‘রাজধানীতে চলাচল করা বিজ্ঞাপনে মোড়ানো কিছু এসি বাস আমাদেরও নজরে এসেছে। গণপরিবহন এভাবে বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেওয়ার কোনো বিধান আছে বলে আমার জানা নেই। এ ধরনের গণপরিবহন নারীর জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে। আমরা এ বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির (বিআরটিএ) কাছে চিঠি পাঠানোর কথা চিন্তা করেছি।’

মোজাম্মেল হক চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করেন, বিজ্ঞাপনে মোড়ানো বাসগুলো রাজধানীতেই চলাচল করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের চোখ এড়ানোর কথা নয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা নেই।

২০১৪ সালে মাইক্রোবাসসহ সব ধরনের যানবাহন থেকে কালো কাচ খুলে ফেলতে নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস লাগানোর জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অভিযানে মামলা ও জরিমানা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল কার্যক্রমের পরিচালক আবুল হোসেন বললেন, পুলিশের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় যানবাহনের জানালার কাচ যাতে স্বচ্ছ হয়, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়। গণপরিবহনের দরজা ও জানালার কাচ অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে, বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেওয়ার তো কোনো সুযোগই নেই।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট আইনজীবী সালমা আলী বললেন, বিজ্ঞাপনে মোড়ানো বাসগুলোয় যৌন নিপীড়ক বা আসামিদের আরও অপরাধ করার সুযোগ করে দেবে। নারীর নিরাপত্তা এতে চরমভাবে বিঘ্নিত হবে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহও জানালেন, বিজ্ঞাপনে মোড়ানো বাসের বিষয়টি তাঁদেরও চোখে পড়েছে। বললেন, বিষয়টি নারীদের জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যারা করছে তারা ব্যবসায়িক চিন্তা থেকেই করছে। আইনবহির্ভূত হলে বিআরটিএ অবশ্যই বাস ও বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ তে বলা আছে, সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এ ধরনের কোনো ধরনের ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্যিক কার্যক্রম মোটরযানে পরিচালনা করা যাবে না না বা পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হবে না। তবে সরকারি কর্মসূচির অধীন বিক্রয়, হস্তান্তর বা প্রমোশনাল কার্যক্রম এর আওতাভুক্ত হবে না।

প্রথম আলোর মাধ্যমে বিষয়টি অবগত হলেন বলে উল্লেখ করে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বললেন, এ ধরনের গণপরিবহন রাস্তায় চলবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। গণপরিবহনের গ্লাস অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। সোহেল রানা বিষয়টি পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে জানিয়ে দ্রুত সমাধানেরও আশ্বাস দিয়েছেন।