'আমার পানি লাগবে না, তোমরা আগুন থেকে বের হও'

আগুন লেগে ফতুল্লার এই বাড়িটির অধিকাংশই পুড়ে গেছে। ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ১৭ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দিনার মাহমুদ
আগুন লেগে ফতুল্লার এই বাড়িটির অধিকাংশই পুড়ে গেছে। ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ১৭ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দিনার মাহমুদ

প্রতিদিনের মতো ভোরে উঠে পরিবারের সদস্যদের জন্য নাশতা বানাতে রান্নাঘরে যান বৃদ্ধা নূরজাহান বেগম। চুলায় আগুন জ্বালাতেই তাঁর পুরো শরীরে আগুন ধরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হন তিনি। পরিবারের বাকিরা যখন তাঁর শরীরের আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন তিনি আকুতি নিয়ে বলেন, ‘আমার জ্বলে না, পানি লাগবে না। তোমরা সবাই আগুন থেকে বের হও।’

আজ সোমবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার সাহেবপাড়া এলাকায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে বৃদ্ধা নূরজাহানের মৃত্যুর পর এভাবেই পুরো পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন নিহতের পুত্রবধূ লিপি আক্তার। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী-সন্তানসহ মোট আটজন অগ্নিদগ্ধ হন। পাশের ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় আগুন থেকে রক্ষা পান লিপি ও তাঁর ১৩ মাস বয়সী মেয়ে ইকরা মনি।

পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিপি আক্তার বলেন, নূরজাহানের চিৎকার শুনে তাঁকে বাঁচাতে ছুটে যান লিপির স্বামী কিরণ মিয়া। মায়ের শরীরে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন কিরণ। এ সময় নূরজাহান বেগম সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য ছেলের কাছে আকুতি জানান। পরে তাঁকে একটি কাঁথা দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য চিৎকার শুরু করলে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

লিপি বলেন, ‘আমি বারান্দার দরজা খুলে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দিই। পরে প্রতিবেশীরা বারান্দার গ্রিল ভেঙে আমার মেয়েকে বের করে। পরে বাচ্চাকে বাইরে রেখে ঘরে ঢুকে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি।’

সোমবারের এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একজন নিহতের পাশাপাশি সাতজন দগ্ধ হয়েছেন। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। আহতদের মধ্যে দুজন শিশু।

নিহত নূরজাহান বেগমের পুত্রবধূ লিপি আক্তারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশী ও পরিবারের সদস্যরা। ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ১৭ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দিনার মাহমুদ
নিহত নূরজাহান বেগমের পুত্রবধূ লিপি আক্তারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশী ও পরিবারের সদস্যরা। ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ১৭ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দিনার মাহমুদ

তিতাস গ্যাসের প্রতি এলাকাবাসীর ক্ষোভ

এদিকে নূরজাহান বেগমের মৃত্যু ও তাঁর পরিবারের সাতজনের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনার জন্য এলাকাবাসী তিতাসকে দায়ী করেন। তাঁদের দাবি, তিতাসের পাইপলাইনে দিনের পর দিন গ্যাস থাকে না।

এলাকার বাসিন্দা মর্জিনা বেগম বলেন, ‘মাঝে মাঝে রাত তিন-চারটার দিকে একটু গ্যাস আসে। এক থেকে দুই ঘণ্টা থেকে আবার ভোরেই চলে যায়। গ্যাস ব্যবহার না করেও আমরা বিল দিচ্ছি। এই গ্যাসের জন্য এখন জীবনও দিতে হচ্ছে। আমরা এই সমস্যার সমাধান চাই, গ্যাস দেওয়া না হলে গ্যাসের সকল পাইপলাইন তুলে নিয়ে যাওয়া হোক।’

ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা কাকলী বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে আমরা এক বেলা রান্না করে তিন বেলা খাই। লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা এই সংকটে ভুগছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’

ওই বাড়ির মালিক ফারুক আহমেদের স্ত্রী তাহমিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস না থাকায় তারা চুলার চাবি বন্ধ করেনি। এই কারণে ঘরে গ্যাস জমে আগুন ধরে যায়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, পাইপলাইনের গ্যাসের চুলার পাশে একটি সিলিন্ডার ছিল। কিন্তু সেটি অক্ষত ছিল। গ্যাসের চুলার চাবি খুলে রাখায় ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে ।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক মফিজুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।