জুয়া নিষিদ্ধে আদালতের নির্দেশের পর ক্লাবগুলো দ্বিধায়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

হাউজি বন্ধে আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ক্লাবসহ ঐতিহ্যবাহী একাধিক সামাজিক ক্লাব। ক্লাবের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ‘জুয়া’র সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা জানতে চান। তাঁরা বলছেন, স্পোর্টস ক্লাবে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত ক্যাসিনো আর সামাজিক ক্লাবের ইনডোর গেমস এক নয়।

ঢাকা ক্লাব ও গুলশান ক্লাব গতকাল সোমবার হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছে। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে এই আবেদনের ওপর শুনানির জন্য পাঠিয়েছেন চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

এর আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ক্লাবে টাকার বিনিময়ে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন। তারও আগে ২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর দেশের ১৩টি ক্লাবে টাকার বিনিময়ে জুয়া খেলা বন্ধে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।

এই ক্লাবগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ জীবনরীতি ও সংস্কৃতিচর্চার জন্য ১৯১১ সালে ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ক্লাব, ১৯৫১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের স্ত্রী বেগম শামস সাহাবুদ্দীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা লেডিস ক্লাব রয়েছে। এর বাইরে আছে গুলশান ক্লাব, বনানী ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব ঢাকা, ঢাকা লেডিস ক্লাব, ক্যাডেট কলেজ ক্লাব গুলশান, চিটাগাং ক্লাব, চিটাগাং সিনিয়র্স ক্লাব, নারায়ণঞ্জ ক্লাব ও খুলনা ক্লাব।

আদালত রায়ে বলেছেন, লটারি ছাড়া হাউজি, ডাইস, ওয়ান-টেন, চরচরির মতো অন্যান্য খেলা দক্ষতার পরিবর্তে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। আইনে এগুলো নিষেধ আছে। আদালত এ ধরনের খেলার অনুমতি, আয়োজন করা ও অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি এসব খেলার ইলেকট্রনিক ও অন্য সরঞ্জামাদি জব্দ করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্লাবগুলো ইতিমধ্যেই আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। অন্তত চারটি ক্লাবের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেছেন, তাঁরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আদালতের নির্দেশ মেনে চলতে প্রস্তুত আছেন। তবে শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালাতে চান।

এদিকে ক্লাবে যাতায়াত আছে, এমন কেউ কেউ আছেন দ্বিধায়। ক্লাবে গেলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে কি না, সেই আশঙ্কায় আছেন। কেউ কেউ ভাবছেন, ঘরেই ‘ইনডোর গেমসে’র আয়োজন করবেন। কারণ, এর উদ্দেশ্য শুধু বিনোদন, সামাজিক যোগাযোগ।

>

ঢাকাসহ সারা দেশের ক্লাবে টাকার বিনিময়ে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন হাইকোর্ট
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে ঢাকা ক্লাব ও গুলশান ক্লাবের আবেদন

ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট খায়রুল মজিদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রায়ের কপি হাতে পাইনি। পত্রপত্রিকা মারফত আদালতের সিদ্ধান্ত জেনে আমি বিস্মিত এবং দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অপমানিত বোধ করছি। মনে হলো, যারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ক্যাসিনো চালাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো তফাত নেই। অথচ দুটো বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা।’

রিটকারীদের যুক্তি, ক্লাব যা বলছে

রিটকারীদের পক্ষে আইনজীবী রেদওয়ান আহমেদের দাবি, নামীদামি ১৩টি ক্লাব বেআইনি ব্যবসা করছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে গোটা সমাজে। ক্লাবে টাকার বিনিময়ে যে খেলা চলছে, তা অনৈতিক, জনশান্তির বিঘ্ন ঘটায়, তরুণদের বিপথগামী করে এবং পরিবারে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটায়। রিটে আইনজীবীরা মোটাদাগে যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা হলো ঐতিহ্যবাহী ক্লাবে ইনডোর গেমসের নামে যা চলছে, তা বেআইনি ব্যবসা। প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭-এর ৩ ধারা অনুযায়ী ‘কমন গেমিং হাউজ’, অর্থাৎ জুয়ার জন্য কোনো স্থানের মালিকানা থাকা, রাখা বা তত্ত্বাবধান করা অপরাধ। ক্লাবগুলো সেটাই করছে।

তা ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে জুয়া ও গণিকাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দরিদ্রদের টাকার বিনিময়ে খেলায় বাধা দিলেও ক্লাবগুলোয় অভিজাত লোকজন নির্বিঘ্নেœখেলছে।

অন্যদিকে ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, বনানী ক্লাব পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, বেআইনি ব্যবসার যে কথা বলা হয়েছে, সেটা মিথ্যা কথা। খায়রুল মজিদ মাহমুদ বলেন, ঢাকা ক্লাবের সদস্য কে নন? সাবেক ও বর্তমান বিচারপতি, সামরিক-বেসামরিক আমলা, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এককথায় সমাজের অগ্রসর অংশের প্রতিনিধিদের মিলনকেন্দ্র হলো এই ক্লাব। এর সদস্যরা নিছক চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ইনডোর গেমসে অংশ নেন। তাঁরা সম্পদ গড়তে বা নিঃস্ব হতে ক্লাবে আসেন না। ক্লাবের পরিচালন ব্যয়ও এখান থেকে মেটানো হয় না। এটা লাভজনক কোনো খেলাই নয়। আর এখানে সবার প্রবেশাধিকারও নেই।

নিয়মিত ক্লাবের ইনডোর গেমসে অংশ নেন, এমন তিনজনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা বলছেন, তাস খেলা, ডাইস, হাউজি—এ খেলাগুলোর আসল উদ্দেশ্য আমোদ-ফুর্তি, এতে সামাজিক বন্ধন বাড়ে। যাঁরা খেলেন, তাঁরাই টাকাটা দেন। একজন নারী বলেছেন, খেলাটা লটারির মতো। লটারি জিতলে যেমন পুরস্কার পাওয়া যায়, এখানেও তেমন। অপর একজন বলেছেন, পুরস্কার হিসেবে বিমানভ্রমণ বা বেড়ানোর টিকিট পাওয়া যায় কখনো কখনো। সমাজের প্রতিষ্ঠিত লোকজনের সমাগম হয় বলে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তাঁদের পণ্যের প্রচারের জন্যও এই মঞ্চকে বেছে নেন। তাঁরা পুরস্কার দিয়ে দেন।

রিট আবেদনকারীরা বেশ কিছু ছবি যুক্ত করেছিলেন আবেদনে, যেখানে আলাদাভাবে পুরুষ ও নারীদের কার্ড বা হাউজি খেলতে দেখা যায়। ঢাকা ক্লাবের পক্ষে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ছবিগুলো ক্লাব সদস্য ও তাঁদের পরিবারের লোকজনের। এটা পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্টের বা প্রকাশ্য জুয়া আইনের মধ্যে বা দেশের অন্য কোনো আইনের মধ্যে পড়ে না।

বনানী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, তরুণসমাজকে বিপথগামী করা বা পারিবারিক অবক্ষয়ের যে কথা তোলা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। কারণ, প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ছাড়া কেউ ক্লাবের সদস্য হতে পারেন না এবং তাঁদের বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। তিনি আরও বলেন, জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধনের মাধ্যমে সামাজিক ক্লাব চলে কঠিন কিছু শর্তের বিনিময়ে। সেগুলো সব ক্লাব মানছে কি না, বরং সেদিকে নজর দেওয়া যায়।

গুলশান ক্লাবের সদ্য সাবেক সভাপতি শওকত আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, বলা হচ্ছে টাকা খাটিয়ে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে যে খেলা হয়, সেটাই জুয়া। সরকার যেকোনো মহৎ উদ্দেশ্যে লটারির আয়োজন করে কিংবা প্রাইজবন্ড ছাড়ে। সেখানেও কিন্তু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করেই টাকা খাটানো হয়।

জুয়ার আইন স্পষ্ট নয়

১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইন এখনো বাংলাদেশে বলবৎ আছে। তবে ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে প্রথমে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশে ঢাকাকে এই আইনের আওতামুক্ত করা হয়। দুই বছর পর অন্যান্য মহানগরকেও আওতামুক্ত করা হয়। তবে সড়ক বা জনসমাগম হয়, এমন জায়গায় জুয়ার আসর বসালে ২০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়।

সে ক্ষেত্রে আদালতের নতুন এই আদেশের ফলে কী হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। জুয়া, ক্যাসিনো ও সামাজিক ক্লাবের ইনডোর গেমসের পার্থক্য পরিষ্কার হওয়া দরকার বলে মনে করছেন ক্লাবকর্তারা।

জানা যায়, ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত এই আইন এখন যুক্তরাজ্যেই অচল। এখন দেশটিতে গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ২০০৫ কার্যকর আছে। মালয়েশিয়ায় সীমিত আকারে জুয়ার প্রচলন আছে। প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল গ্যাম্বলিং অ্যান্ড প্রাইজ কম্পিটিশন অ্যাক্ট, ১৯৫৭’-র মাধ্যমে তাস খেলাকে জুয়ার কাতার থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বহু আগেই। গোয়া ও সিকিমেও কিছু শর্ত মেনে অনুমতি দেওয়া হয়েছে ইনডোর গেমসের।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী আমীর–উল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাউজি বা তাসের মতো বিষয় যখন কারও বাড়ি বা প্রাইভেট ক্লাবে চলে, তখন তা নিষিদ্ধ নয়। কারণ, তা ‘কমন গেমিং হাউজের’ মধ্যে পড়ে না। বাড়ি বা প্রাইভেট ক্লাবে তাস বা হাউজি খেলা নির্দোষ বিনোদন বা সময় কাটানোর জন্যই। এখানে সীমিতভাবে অর্থের লেনদেন থাকতে পারে, তাসের খেলায় কখনো অর্থ নিয়ে তা আবার খেলা শেষে ফেরত দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। তাই অর্থের সংস্রব ঘটলেই সেসব ‘প্রকাশ্য জুয়া খেলা’ হয় না। তিনি মনে করেন, প্রচলিত আইনকে এভাবেও ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে।